রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
ল্যাজে পা
দিন-কে-দিন বিরক্তি বেড়ে চলেছে। অ্যাশট্রেতেও আর জায়গা বিশেষ নেই। ছোটবেলা থেকে যা জানলাম, যা শিখলাম, প্রবাদ বলে যা বিশ্বাস করলাম, তা আদতে বিরোধীদের অপপ্রচার ভাবতেই কেমন গা-গুলিয়ে ওঠে। এ যেন আমাদের অমল কৈশোরের সঙ্গে ‘নিউটন-নিউটন’ খেলা। নিউটন লোকটার ওপর এমনিতেই আমার প্রবল খার। একে তো ওই বাবরি চুল, যেন মোগ্যাম্বোর অ্যান্টিথিসিস। তার ওপর ‘গাছ থেকে আপেল পড়ল কেন’ এটা কোনও প্রশ্ন হল? ওরে, আপেল পড়েছে তুই খা, পাড়া-প্রতিবেশীকে খাওয়া, না হলে বাপ আদমকে উচ্ছুগ্গ কর! তা না, আপেল পড়ার মতো নির্দোষ আনন্দময় একটা ঘটনাকে টেক্সটবইয়ের বাঁশে রূপান্তর। আর শিক্ষাব্যবস্থার তঞ্চকতা তো আর এক কাঠি উপরে। ক্লাস টেন পর্যন্ত নাগাড়ে পড়ো নিউটনের সূত্র, তার পর পড়ো নিউটনের সূত্র ভুল ছিল এবং কেন ছিল তা প্রমাণ করো। অর্থাৎ কিনা, অ্যাদ্দিন যা পড়লে, বিরোধীদের অপপ্রচার।
বেসিক ও অ্যাসিডিক সমস্যা প্রবাদ নিয়ে। প্রবাদ, অর্থাৎ কিনা প্রতিষ্ঠিত মতবাদ তার থেকে বড় মিথ্যে খুব কমই থাকে। সহজ উদাহরণ চান? ছোটবেলা থেকে ধর্ম, জিরাফ, আর অবশ্যই বিশ্ববিখ্যাত ছবি ‘রশোমন’, সবাই বলেছে, পৃথিবীতে ‘ধ্রুব সত্য’ বলে নাকি কিছু হয় না। সব কিছুই এ দিক থেকে দেখলে সিধে, আবার ও দিক থেকে দেখলে ট্যারা। বিদ্যাসাগর সাধারণ মানুষের দিক থেকে দেখলে উন্নতশির, নকশালদের দিক থেকে দেখলে মুণ্ডহীন। পৃথিবী ভূগোল বইয়ের দিক থেকে দেখলে বনবন ঘুরন্ত, কে.সি.পালের দিক থেকে অ্যাক্কেবারে স্থির। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই সূত্রের চেয়ে ডাহা মিথ্যে ক’টা আছে? অনেক জিনিসই আদৌ আপেক্ষিক নয়। যেমন ধরুন, হিমেশ রেশমিয়ার গান! তা খারাপ, এবং খারাপই। এর কোনও এ-দিক সে-দিক হতে পারে না। অথবা ধরুন, যার নাক বন্ধ হয়ে গেছে, সে কখনও বলতে পারে না ‘আমার নাক বন্ধ হয়ে গেছে।’ তাকে বলতেই হবে ‘আঁবার নাঁক বঁদ্ধ হঁয়ে গেঁছে।’ যদি কক্ষনও বলে ‘আমার নাক বন্ধ হয়ে গেছে’, আর যাই হোক, নাক বন্ধ হয়নি। এগুলো জীবনের জটিল ধ্রুব সত্য।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তার পর, ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি খবরের কাগজ সমাজের আয়না। আয়নাই বটে। না হলে এর’ম ডান-বাঁ গুলিয়ে দেয়? কোনও সুস্থ মানুষ যদি ইদানীং একসঙ্গে দু’টো খবরের কাগজ পড়ে, এবং খবরগুলোকে বিশ্বাস করে, উন্মাদ হয়ে যাবে। যে ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা কাগজ সরকারের তুলে ধুনে দিল, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আর এক কাগজ সরকারকে মাথায় তুলে তুঙ্গ ‘সাম্বা ডান্স’ করছে। আব্বে, সত্যিটা কী? টিআরপি বাড়াবার জন্য কিংবা নির্দিষ্ট দলের পা-চাটার জন্য সব নীতি নর্দমায় ফেলে দিনকে রাত্তির, মাছকে পুঁইশাক, মাসিকে মামা করা যায়! কিন্তু কাগজ-বিশেষজ্ঞ হয়তো হেসে গড়িয়ে বলবে, আরে সরল ভাই আমার, ‘ধ্রুব খবর’ বলে কিচ্ছু হয় না। তা-ই সত্য, যা ছাপিবে তুমি! তুমি হয়তো ভাবলে উল্টোডাঙায় নারী ধর্ষিতা হয়েছে, আমার সাংবাদিক হয়তো ভাবল, ডাঙায় নারী-উল্টো, অর্থাৎ পুরুষ, ধর্ষিত হয়েছে। যা ভাবার জন্য পয়সা পাই, দিনের শেষে তা-ই ভাবতে চাই। বিজেপি-র কাছে যে রাম অকল্পনীয় হিরো, মেঘনাদবধ কাব্যে সে-ই তো ভয়াবহ ভিলেন। তা হলে, রাম কি বলবেন, মাইকেলের লেখাপত্তর বিরোধীদের অপপ্রচার? অকাট্য যুক্তি। তাতেই আরও রাগ বেড়ে যায়। এই আপেক্ষিকতার ব্যাপারটা কিছুতেই সল্ভ করা যাচ্ছে না। মাথা গরম হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক আপেল দেখে খেতে ভয় হয়। কারণ আমার কাছে যা ফল, তা-ই তো কত ছাত্রছাত্রীর জঘন্য ফলের কারণ! সার বুঝেছি, খবরকাগজ, বা আর একটু প্রসারিত করে বললে মিডিয়া, অর্থাৎ কিনা টিভি-ও, সত্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, যে কোনও খবর নিজেদের খেয়ালখুশি মতো যে কোনও ভাবে, যে কোনও রঙে রাঙিয়ে উপস্থাপিত করবে, তার পর কৈফিয়ত চাইলে বলবে ‘বেশ করেছি’, রাজনীতির পাণ্ডারা প্রকাশ্য টক-শো’তে আজ বলবেন ‘ক’, কাল ডিগবাজি খেয়ে বলবেন ‘খ’, পরশু বলবেন প্রথমটা ছিল অপপ্রচার, তরশু আবার ‘ক’-তে ফিরে গিয়ে বলবেন, ‘এটাই ঠিক পুনঃপ্রচার’!
এমনিতেই দাড়ি বা যে-কোনও কারণেই হোক, লোকে আমাকে ঠাটিয়ে আঁতেল ভাবে। এ দিকে কামু বললে আমার মুখোপাধ্যায় আগে মনে পড়ে, আলব্যের পরে। কিন্তু এই ইমেজটা, মাইরি, দিব্যি লাগে। আর ‘শিক্ষিত’ হওয়া এত সোজা, ভাবলেই আরাম হয়। সাধারণ মানুষ বোকার মতো ভাবেন, বোধহয় খুব পড়াশোনা করতে হয়। আরে ধুর, শুধু কয়েকটা টার্ম জানা দরকার। যদি দেখেন সবাই নাগাড়ে কোনও লেখা, সিনেমা বা নাটকের নিন্দে করছে, তখন বোকার মতন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বিচ্ছিরি, যাচ্ছেতাই’ চেঁচিয়ে উঠলে হবে না। বলতে হবে (গলা খাদে নামিয়ে) ‘ওঁর, ইয়ে, পার্সপেক্টিভটা আমার পছন্দ নয়।’ এই ডায়ালগটা খুব শিখে-টিখে আর বার চুয়াল্লিশ অব্যর্থ প্রয়োগ করে, এক বার ডিপ-নলেজ পাওয়ার জন্য এক আঁতেল বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম, ‘এই পার্সপেক্টিভটা কী রে?’ সে যথোচিত গাম্ভীর্য নিয়ে বলল ‘যা রোজ বদলাতে হয়।’ আমি সোৎসাহে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অ, জাঙিয়া?’ তার পর থেকে আমি নন্দনে নট অ্যালাউড।
কিন্তু এটা হাড়ে হাড়ে বুঝছি, যে ফিল্ডেই যাও, আর্ট বা সায়েন্স, এই বদল ব্যাপারটাকে পুজো করতে হবে। রোজ বদলাতে হবে। হয় পার্সপেক্টিভ, নয় প্রতিবেদনের ধাঁচ, নয় পার্টি-মোসাহেবি। এই ছিলাম সরকারের চ্যানেল, এই হলাম বিরোধীর। এই ছিলাম গাছের নিরীহ আপেল, এই হলাম যুগান্তকারী তত্ত্বের প্রাণভোমরা। এই ছিলাম অমুক পরিচালকের ভক্ত, ওই হয়ে গেলাম তার সবচেয়ে বড় নিন্দুক। বদলের আর এক নাম জীবন। জীবনের আর এক নাম ইউ-টার্ন।
আমার ‘কিছু জিনিস অনড়’ থিয়োরিটা তাই আর ধোপে টিকছে না। যা শুনে একদম ভেঙে পড়েছি, সেই সদ্য-খবরটা বলি। ছোটবেলা থেকে জেনেছি, সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরের শত্রু। কিন্তু ভারতেরই এক প্রদেশে ঘটে গেছে এক লোমহর্ষক বিভীষিকা। সেই প্রদেশে অ্যাদ্দিন দেখা যেত, সরকার ও বিরোধী পক্ষ যাবতীয় ইস্যুতে দ্বিমত পোষণ করে। এ যেই না বলে জল, ও তক্ষুনি চিল্লে ওঠে, তেল। সবাই বলে, সাপে-বেজিতেও ভাব হতে পারে, শেয়াল-কুকুরের বিয়ে ঘটতে পারে, কিন্তু এ দু’জনের চিরকালের কাট্টি। মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী পক্ষের দলনেতার লাগাতার মিটিং হয়, কিছুতেই সমাধানসূত্র বেরোয় না। তার পর, এক দিন, মিটিং-এর ঘরে রাখা এক লুকনো ক্যামেরায় একটি স্টিং অপারেশনে, বেরিয়ে এল চমকে দেওয়া সত্য। মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা আশৈশব বন্ধু। ছোট থেকেই এঁদের একটাই নেশা ক্যারম খেলা। বড় হয়ে উলটো-শিবিরে দু’জনে যোগ দিলে কী হবে, রোজ মিটিং-এর নামে ক্যারমই খেলা হত নিয়ম করে। প্রচণ্ড বাদানুবাদের একটি সিডি রেকর্ড করা ছিল, সেটা চালিয়ে দেওয়া হত স্ট্রাইকারের আওয়াজ চাপা দেওয়ার জন্য। গেম শেষ হলে থমথমে মুখে বেরিয়ে আসতেন দু’জন। হন্তদন্ত সংবাদমাধ্যম: মিটিং-এ কী ঠিক হল? গম্ভীর মুখে ওঁদের উত্তর: পরবর্তী মিটিংয়ের ডেট। এতে কী প্রমাণ হল শেষ অবধি? সব ধারণাই ওলটায়, পালটায়? বিরোধীরাও এক ঘাটে জল খায়? না কি, উলটোটাই? আর যা-ই পালটে যাক এই নশ্বর জগতে, ক্যারম-অভ্যাস কিছুতেই পালটায় না? কে জানে, গুলিয়ে গেছে। শুধু নাক বন্ধ হয়ে গেলে, নিজের বিশ্বাসটা ফিরে আসে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.