রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
আমার প্রথম বই
মার গদ্যে-লেখা প্রথম বই ‘ফুলবউ’। তার আগে ১৯ বছর বয়সে প্রকাশ পেয়েছিল ‘জড় উপড়ানো ডালপালা-ভাঙা আর এক ঋ
তু’ নামে একটি কবিতার বই। ‘ফুলবউ’ একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি বার ছয় লিখেছি। অর্থাৎ, ছয় বার এর লিখন-পুনর্লিখন হয়েছে; একটা খসড়া থেকে আর এক খসড়ায় চলে গেছি। শুরুতে এটি ছিল একটি গল্প ধরনের পদার্থ। একটা এলেবেলে ধরনেরই নাম ছিল সেটার। ‘খালাস’।
ওই নামে যদি অর্ধমুকুলিত আধামাটা একটা গল্প ছাপা হত, তা হলে কী এমন আলোড়ন হত সংসারে! পুকুরের জলে খোলামকুচি ছুড়ে ছুটিয়ে দিলে যে তিরতিরে জলবিলি হয় বা যে মৃদু জলোচ্ছ্বাস হয়, তার বেশি কিছুই কি হত! জলের সেই চিরে যাওয়া সিঁথি হয়তো মুহূর্তে মিলিয়ে যেত জলে! ‘ফুলবউ’ নামটাও প্রথমে আমার মাথায় আসেনি।
প্লটটাকে ঠিকঠাক হাতের মুঠোয় পেতে আদরা বদলাতে বদলাতে আস্তে-ধীরে এগোতে হয়, আমার ধাত এ রকমের। প্লট তৈরির ব্যাপারে আমি শরৎপন্থী। উপন্যাসের শেষটা খানিক আন্দাজ করতে না পারলে উপন্যাসে বিসমিল্লা করাটা মনঃপূত হয় না। তা ছাড়া, লিখে দু’-ছয় মাস ফেলে রেখে, ফের লেগে পড়তে পারলে ভাল হয়, যদিও সেই সুযোগ-পরিসর আজ আর নেই। যা হোক, আরও বার ছয় পুনর্লিখনে ‘ফুলবউ’ হতে পারত গদ্যে লেখা Saga (সাগা)। অর্থাৎ, সুদীর্ঘ একটি জটিল কাহিনি। তা না হয়ে যা হয়েছে, তা আদতে সরল একটি আঁটোসাটো বিস্ফোরক ব্যাপারই হয়েছে। উপন্যাস লিখে আমাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছে।
গ্রামের ধর্মগোঁড়া লোকেরা ওই কাহিনি মোটে ভাল চোখে নেয়নি। অথচ উপন্যাসের মূল ঘটনা অন্য এক ভাবে পাশের এক গ্রামে ঘটেছিল। সেই ঘটনা থেকেই কাহিনি একটু-একটু করে মাথার মধ্যে ছাঁচ বাঁধতে শুরু করে এবং ছাঁচ পালটে পালটে যায়।
মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্বাঞ্চল উপন্যাসের অবলম্বন। ওই জনপদ পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ বাঙালিরই অচেনা। এমনকি হিন্দু ধর্মসংস্কৃতি প্রভাবিত মুর্শিদাবাদী রাঢ় বাংলার মানুষও ওই পূর্বাঞ্চলকে ভাল চেনেন না। শহরের বাসিন্দা বাবু সম্প্রদায় পর্যন্ত ওই গ্রামের চালচিত্র বোঝেন না। ঘোর, অতি ঘোর মুসলিম-অধ্যুষিত জায়গা। ৯৮ শতাংশ মুসলমান, গ্রামের পর গ্রাম।
এমন গ্রামও আছে, যেখানে একটিও হিন্দু নেই। বাঙালি হিন্দুর সাক্ষাৎ পেতে গঞ্জে আসতে হয়। তবে এক গহন মুসলিম-গ্রাম এবং খাপছাড়া ভাবে বহরমপুর-গোরাবাজার মিলে ‘ফুলবউ’-এর প্রেক্ষাপট বা চলাচলের জায়গা ঠিক হয়। ‘ফুলবউ’ যখন শহরে হিন্দু-জীবন ঘেঁষে চলে, তখনও সে বাঙালির হিন্দু-জীবনে জড়ায় না নিজেকে জড়ানো হয় না তার; সে তার নিজের মতো চলতে থাকে; কারণ ধর্ম-সংস্কার তার জীবন-গতিপথ বেঁধে দিয়েছে।
পাঠককে কথাগুলো খুলে কখনও বলিনি। আজ বলছি। আমার ধারণা, সর্ব ক্ষণ হিন্দু-সংসর্গে-থাকা মুসলমান আর শুধু মুসলিম-সংসর্গে থাকা মুসলমান (কচ্চিৎ হিন্দু-সংসর্গ) জীব হিসেবে আলাদা। শুধু মুসলমান যেখানে, সেখানে সংকট আলাদা। গোঁড়ামি আলাদা। নারীর দুঃখ আলাদা। নারীর উপর নিষ্পেষণ ও ফলত হুতাশন ও গোঙানি আলাদা। কথায় কথায় সেখানে মেয়ে তালাক হয়। মুর্শিদাবাদ মেয়ে পাচারে জেলাগুলির মধ্যে এক নম্বরে শোভা পাচ্ছে। জীবনের অমন ছিনিমিনি আর কোথাও তো দেখলাম না। ধর্ম আর দারিদ্র একেবারে লেপে আছে। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, দ্বিবিবাহ ওই জনপদে ঢুঁড়ে বেড়াতে হয় না। এ-মুড়ো থেকে ক্ষুদ্র গ্রামের ও-মুড়ো গেলেই ওই ‘বিহা’ চোখে পড়ে, অমন বিহাতি চোখে পড়ে। আমার গ্রামজীবনের সব চেয়ে আপনার সাহিত্যিক-বন্ধু রকিবউদ্দিন ইউসুফের বাবার ছিল তিন পত্নী, তিনি চতুর্থ বিবাহের জন্য ছটফট করতেন; কারণ ওই বিয়ে শাস্ত্র-আধারিত সুন্নত।
কিন্তু প্রশ্ন, ‘এ জীবন লইয়া কী করিব?’ ফেলে রাখব, না কি লিখব? যদি লিখি, কী কৌশলে লিখব? দুরূহ কোনও ফরাসি রীতির দিকে গেলাম না। রবীন্দ্র-শরৎকে অনুসরণ করে সহজ-সরল পন্থায় ‘ফুলবউ’ লিখলাম। ঔৎসুক্য-উৎকণ্ঠা ভরা ঘটনা দিলাম গল্পের বয়েতে। তার আগে বহরমপুরে এক সাহিত্যানুষ্ঠানে দেখা সমালোচক-লেখক-অধ্যাপক-রসজ্ঞ-কথক দাদা শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনিই আমার সাহিত্যের গোমুখ ও সূচনাফল অবধি চিনতেন। বললেন, গল্প তো কিছু লিখেছ, এ বার উপন্যাসে হাত দাও। কব্জি লড়িয়ে লেখো তো একটা...আপস কোরো না। লক্ষ রাখবে, কোনও গল্পের মধ্যে উপন্যাসের বীজ রয়েছে না কি!
একেই বলে দম লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া। গল্পের মধ্যে উপন্যাসের বীজ! চোখ গেল খুলে। ‘খালাস’ হয়ে উঠল ‘ফুলবউ’। কিন্তু ছাপে কে? যে-বিষয়বস্তু যে-কেতায় উপন্যাসে খেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ছাপানোর সাহস ও আগ্রহ হয়তো কারও থাকবে না। বৃহৎ পত্রিকা ঝুঁকি নেবে না।
কিন্তু উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়েটড়ে দাদা যা করবার তা-ই করলেন। আমায় কোনও বার্তা না দিয়ে পাণ্ডুলিপি সাগরময় ঘোষের টেবিলে পৌঁছে দিলেন। ‘ফুলবউ’-এর প্রকাশ-আকুলতা দাদার ক্ষেত্রে ছিল আকাশচুম্বী গোপন জলোচ্ছ্বাসের মতো। তিনি চাইতেন সাহিত্যে আমার বোধন পূর্ণ হোক।
তবে উপন্যাস হাতে পাওয়ার আগেই ১৯৮৬ সালে শারদীয় ‘দেশ’-এ সাগরময় সুপ্রতিষ্ঠিতদের সঙ্গে একমাত্র এক নবীনের ধর্মদারিদ্রমাখা অদ্ভুত জনপদের কাহিনি ‘অন্য নকশি’ ছাপেন; নবীনের নাম আবুল বাশার। গল্পটি আমার গাঁ থেকে পাঠানো দ্বিতীয় গল্প, সাধারণ সংখ্যার জন্য। গল্পটাকে শারদীয় সংখ্যার জন্য আলাদা করে সরিয়ে রেখেছিলেন ‘দেশ’ সম্পাদক।
অবশ্য গল্পটি আদৌ ছাপা হয় কি না সংশয় ছিল। কেননা, ‘দেশ’ দফতরে গল্প গেছে আট মাস, কোনও খবর নেই। ভেবেছিলাম, ‘দেশ’ এ গল্প ছাপবে না।
কিন্তু যে দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘প্রকাশিত হয়েছে’ বলে শারদীয় ‘দেশ’-এর বিজ্ঞাপন বার হল, সে দিন আনন্দ-বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বিজ্ঞাপনে গল্পের ভাগে তলায় মুদ্রিত শেষ-লেখক ও শেষ গল্প-নামটি আমার। এই ঘটনার পর বাবা বললেন, এ বার তুমি এক বার সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করো। আনন্দবাজারে পৌঁছনোর একটি রোডম্যাপ এবং ট্রাম নম্বর বাবা কাগজে এঁকে ও লিখে দিয়েছিলেন। কারণ, আমি কলকাতা ও আনন্দবাজার চিনতাম না। পৌঁছে দেখি, সাগরময় ঘোষের টেবিলে খোলা অবস্থায় রয়েছে ‘ফুলবউ’-এর পাণ্ডুলিপি। আমার বিস্ময়-বিমূঢ় অবস্থা। সাগরদার প্রথম কথাই ছিল, ‘এসো, তোমার লেখাই পড়ছি। উপন্যাসটি ৪০ ভাগ পড়ে শেষ করেছি। তাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ লেখা আমি ছাপব।’
উপন্যাস বার হল। গ্রামে আর টেকা গেল না। সাগরদা আমাকে গ্রাম থেকে কলকাতায় তুলে আনলেন। বৃহত্তর সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দিলেন। ‘দেশ’ পত্রিকা দফতরে আমার চাকরি হল। ১৯৮৮ সালের আনন্দ পুরস্কার আমাকে দেওয়া হল ‘ফুলবউ’ উপন্যাসের জন্য। প্রথম বই, প্রথম পুরস্কার।
এই উপন্যাসের পাঠক-প্রতিক্রিয়া ও স্বীকৃতি প্রথম এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। যতগুলি তারিফ-সংবলিত চিঠি সেই সময় হাতে পাই, সবই বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের লেখা। প্রবলতর উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের মুসলিম মেয়ের মধ্যে। সেই ভাব-প্লাবন লিখে বলা এক ধরনের কুণ্ঠার ব্যাপার। সে আজ থাক। কিন্তু যা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, তা হল ‘ইমরানা’ কাণ্ড ঘটার পর, এই আনন্দবাজারেই চিঠিপত্র বিভাগে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পত্র প্রকাশিত হয়। লিখেছিলেন কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত মুসলিম। তাঁরা বলেছিলেন, ইমরানাকে বুঝতে হলে, ইমরানার প্রকৃত দুঃখ স্পর্শ করতে হলে ‘ফুলবউ’ পড়তে হবে।
‘ফুলবউ’ আমার একটি সামাজিক কাজ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.