রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
চিরকুটের কাঁটা
সেই ম্যাচের প্রথম দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর কী ঘটল, পঙ্কজ রায় নিজে লিখেছেন ‘আনন্দমেলা’-তে। প্রথম দিনের শেষে ভারত ছিল ২৩৪-০। পঙ্কজ ব্যাটিং ১১৪, মানকড় ব্যাটিং ১০৯। ভারতের প্রথম জুড়ি, যাঁরা আউট না হয়ে গোটা দিন কাটিয়ে দিতে পেরেছে। তাঁদের মাথায় এ বার ঘোরা শুরু হয় হাটন-ওয়াশব্রুকের প্রথম উইকেটে বিশ্বরেকর্ডের কথা। জোহানেসবার্গে করা সেই ৩৫৯ যদি টপকে যাওয়া যায়। খেলা শুরুর আগে ভিনু জিজ্ঞেস করলেন নট-আউট থাকা তাঁর পার্টনারকে। তখন টিম হোটেল ছাড়ছে মাঠে যাওয়ার জন্য।
‘হবে তো পঙ্কজ?’
পঙ্কজ ঘাড় নাড়েন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব।’
ভিনু চেয়ারের হাতলে একটা চাপড় মেরে বললেন, ‘ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের এত কাছে এসে এটা ফস্কে যাওয়া চলবে না। উই হ্যাভ টু স্টে অ্যাট দ্য উইকেট। উইকেটে টিকে থাকলে বিশ্বরেকর্ড আমরা ভেঙে দেবই।’
ব্যাটিং পরিস্থিতি যা ছিল, বাকি টিম দুদ্দাড়ে মেরে ডিক্লারেশন করে দেওয়াটাই সমীচীন। যাতে দ্বিতীয় দিনের শেষ ঘণ্টা নিউজিল্যান্ড ব্যাট করে। কিন্তু ভারত ব্যাট করে যায়। সিরিজে এমনিই এগিয়ে থাকা টিমের অগ্রাধিকার ছিল বিশ্বরেকর্ড। সকালে মাঠে যাওয়ার আগে পঙ্কজ-মানকড় এক প্রস্থ আলোচনা হয়েছিল। এ বার হল উইকেটের ওপর। যাকে বলে মিড উইকেট কনফারেন্স। ঠিক হল, কোনও ঝুঁকি নেওয়া নেই। দ্রুত রানের পিছনে ছোটা নেই। সাবধানী থেকে বিশ্বরেকর্ডটা করে ফেলতে হবে।
গ্যালারি তত ক্ষণে তেতে গিয়েছে। চিৎকার, শাঁখ বাজানো, বিউগল। এত দর্শকের চোখের সামনে খসে গেল ওপেনিংয়ের বিশ্বরেকর্ড। এভারেস্টে ওঠার সময় যেমন হিলারি আগে পা দিয়েছিলেন, তার পরে তেনজিং, এখানেও দু’রান নিয়ে ভিনু ভাঙলেন বিশ্বরেকর্ডকে, পঙ্কজ তাঁর পরে। হাততালি থামতেই চায় না। লোকে জাতীয় পতাকা নাড়ছে, জামা ওড়াচ্ছে, উদ্দাম নাচছে। ভারতীয় ড্রেসিং রুম উঠে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বরেকর্ড বলে কথা! আনন্দের তুঙ্গস্পর্শী মেজাজ!
মনোসংযোগের বিভ্রান্তি ঠিক এই রকম সময়ে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে না হওয়ার কারণ দুই ওপেনারের সেই সময়কার মানসিক গড়ন। পঙ্কজ রায় এই সিরিজেই দুটো টেস্টে বাদ পড়েছেন। বিশ্বরেকর্ডে তাঁর খিদে মিটে যাওয়ার কথা নয়। মানকড়, তিনিও তো আহত পারফর্মার। আগের পাকিস্তান সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে গেছিলেন। যেখানে অপ্রত্যাশিত বিতর্ক তাড়া করে বেড়িয়েছে। পাকিস্তান সফরে এক নর্তকীর প্রেমে নাকি তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই মহিলা গদ্দাফি স্টেডিয়ামের ভি আই পি এনক্লোজারে বসে রুমাল নাড়াতেন। ক্রিজে থাকা মানকড় পাল্টা রুমাল নাড়াতেন! তখনকার যুগ মিডিয়া-অধ্যুষিত না হলেও, পাক-ভারত ক্রিকেট বলেই ঘটনাটা প্রচণ্ড আলোচিত হতে থাকে।
ছবি: সুমন চৌধুরী
সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই করা ২২৩, মানকড়বিরোধী প্রচার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু কর্পোরেশন স্টেডিয়ামের ম্যারাথন পার্টনারশিপ আর তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ভারতীয় রেকর্ড, হাওয়া ফের ভিনুর দিকে ঘুরিয়ে দিল। পলি উমরিগড়ের টস জেতা অবশ্যই ওপেনারদের সাহায্য করেছিল। উইকেট ছিল আপাদমস্তক ব্যাটিং সহায়ক। নিউজিল্যান্ড বোলিংয়ে কোনও রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন না। ছিলেন হ্যারি কেভ, জেন হেইজ, টনি ম্যাকগিবন জাতীয় এমন কিছু প্রতিনিধি, যাঁরা দেশে-বিদেশে নিজেদের সম্পর্কে কোনওরকম সম্ভ্রমই তৈরি করতে পারননি।
তা হলেও, ৪১৩ এমন একটা সংখ্যা, যা পাড়ার ক্রিকেটেও কেউ করার কথা ভাবতে পারে না। দু’জনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দ্রুত খেলছিলেন পঙ্কজ। তিনিই প্রথম শতরানে পৌঁছন। ২৬২ মিনিট তখন তাঁর ক্রিজে কাটানো হয়ে গিয়েছে। মেরেছেন মাত্র ছ’টা বাউন্ডারি। মানকড় নেন সেঞ্চুরি করতে ২৮৭ মিনিট। মারেন ন’টি বাউন্ডারি। হিসেব থেকে পরিষ্কার চার-ছয়ে মোটেও পার্টনারশিপ তৈরি হয়নি। সিঙ্গলস আর দু’রানের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। অর্থাৎ, স্ট্যামিনা এবং এনার্জি অনেক বেশি খরচা হয়েছিল দুজনেরই।
এমনিতে মানকড়-রায় ভারতের হয়ে প্রথম ওপেন করেন ১৯৫১-র ইডেন টেস্টে। ৭২ আর অপরাজিত ১০৩ রান জুড়িতে উঠে যাওয়ার পর ইডেনের পুরনো প্যাভিলিয়নের দেবদারু গাছগুলোও জেনে যায় এই ওপেনিং পার্টনারশিপটা থাকার জন্য এসেছে। এর পর তাঁরা একসঙ্গে করলেন ৩৯ ও ৬। ভরাডুবির ট্রুম্যান-লীলার মধ্যে বাহান্ন-র লর্ডস টেস্টে তাঁরা করেন সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ। তার পর থেকেই জুড়ির অফ ফর্ম শুরু। তখন তাঁদের জুড়ি সম্পর্কে অশ্রদ্ধা উৎপাদনই চলতে থাকে। রান আসে যথাক্রমে ৭, ৪, ৭, ০, ১৯ আর ১।
জুড়ির অনেক কিছু প্রমাণ করার ছিল। সে জন্যই হয়তো এক একটা মাইলফলক তৈরি হয়ে যাচ্ছে দেখেও এঁদের মানসিক কাঠিন্য বিন্দুমাত্র শিথিল হয়নি। মানকড় যখন ক্রমশ পঙ্কজকে ছাড়িয়ে দু’শো রানে পৌঁছে গিয়েছেন, তখনও তিনি পঙ্কজকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, ধরে খেলো। ধরে।
পঙ্কজ তিনিও চান, ডাবল সেঞ্চুরি। যা তাঁর সমালোচকদের তরোয়ালকে দূরের মেরিনা বিচে ছুড়ে ফেলতে পারে। এই সময় হঠাৎ তাঁর কাছে উপস্থিত হল অধিনায়কের নির্দেশ। দ্বাদশ ব্যক্তি বয়ে আনল অধিনায়ক পলি উমরিগড়ের চিরকুট হিট আউট অর গেট আউট। পঙ্কজ বুঝলেন, দু’দিন মিলে প্রায় আট ঘণ্টা কাটিয়ে ফেলেছে তাঁদের পার্টনারশিপ। এ বার অধিনায়ক চাইছেন দ্রুত রান তুলে খেলা শেষের এক ঘণ্টা বিপক্ষকে নামাতে। পঙ্কজকে তার মানে এখনই চালাতে হবে। বেশি দেরি করলে ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।
এ-ই সুরের ছন্দপতন ঘটে গেল কর্পোরেশন স্টেডিয়ামের বাইশ গজে। ওপেনিংয়ে যে পার্টনারশিপ পাঁচশো রান তুলে পরবর্তী দুই শতাব্দীর ব্যাটসম্যানদের জন্য অনতিক্রম্য চিনের প্রাচীর গড়ে রাখতে পারত, সেটা ভেঙে গেল। অফ স্পিনার ম্যাট পোর-কে চালাতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন পঙ্কজ। আউটটা নিয়ে তাঁর আজীবন আক্ষেপ থেকে গিয়েছে। স্পিনার অসম্ভব ভাল খেলতেন পঙ্কজ। সেই তিনি ১৭৩ করার পর যখন ক্রিকেট বলকে ফুটবলের আকারে দেখছেন, তখন কিনা এ ভাবে আউট। তা-ও সেটা যদি দলের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘটত!
ক্যাপ্টেন চিরকুট পাঠালেন। তিনি পঙ্কজ মারলেন! কিন্তু ডিক্লারেশন কোথায়? এর পরে ভারত খেলল আরও ৪৬ ওভার। এই সময়ের মধ্যে অধিনায়ক উমরিগড় করলেন অপরাজিত ৭৯। মানকড় আউট হলেন। তার পর চার নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে নামলেন রামচাঁদ। তিনিও খেলে যাচ্ছেন। রামচাঁদ যদি এত সময় নিয়ে ২১ করতে পারেন, তা হলে তাঁকে চিরকুট পাঠানো হল কেন? এ তো দেখা যাচ্ছে দলের কোনও তাড়াই ছিল না! তাঁকে সম্পূর্ণ বিপথে চালানো হয়েছে।
তত ক্ষণে ভিনু আউট হয়ে ফিরে এসেছেন। পঙ্কজ ড্রেসিং রুমে গেলেন তাঁর কাছে। চিরকুটের কথা শুনে কিন্তু অবাক। ‘সে কী, তুই আমাকে তখন বললি না কেন? কেন শুনতে গেলি হাবিজাবি পরামর্শ!’
জীবনের সর্বোচ্চ রান করে জমকালো বিশ্বরেকর্ডের অংশী হওয়ার পর কোথায় প্রসন্নতা এসে ভিজিয়ে দেবে চশমা-সহ তাঁর গোটা মুখকে। পঙ্কজ ডুবে থাকলেন যন্ত্রণায়। ডাবল সেঞ্চুরির এত বড় সুযোগ তাঁর সামনে এসেছিল। একটা বিষাক্ত চিরকুট সেটা কেড়ে নিল! পঙ্কজ ভুলতে পারেননি তাঁর ক্রিকেটীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপর অধিনায়কের এই নিগ্রহ। তিরিশ বছর বাদে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় তপন চাকি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পঙ্কজ বলছেন, ‘When the score was in the 400’s, I got a chit from our skipper Polly. Hit every ball and get out. I tried to act on his instructions and fell with my individual score at 173. To this day, I can’t fathom why Polly sent this order. Vinoo got his double hundred and severely reprimanded me for listening to Polly.’
তীব্র বিরক্তির সঙ্গে অনেক বছর বাদে পঙ্কজ রোমন্থন করেছেন, ‘বিরক্তির একশেষ করে ছাড়ছিল উমরিগড়। ঠুকুস ঠুকুস করে খেলে যাচ্ছে। আমার বিস্ময় দেখেশুনে আর বাঁধ মানে না। যে ক্যাপ্টেন আমাকে প্রতি বলে গদা ঘোরাবার হুকুম দিয়ে দিল, সে-ই এখন বোলারদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক অনেক পরে যখন তিন উইকেটে ৫৩৭ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার দেওয়া হল, রাগে তখন আমার গা জ্বলছে। ভিনু পরে আমায় অনেক কিছু বলেছিল। যার সারমর্ম হল, সিনিয়র প্লেয়ার এবং ঠোঁটকাটা লোক বলে ভিনুকে চিরকুট পাঠাবার সাহস হয়নি উমরিগড়ের। নিউজিল্যান্ডের ক্লান্ত বিধ্বস্ত বোলিং ঠেঙিয়ে নিজস্ব সেঞ্চুরির সংখ্যা বাড়াবার ইচ্ছে পলিকে চেপে ধরেছিল। কিন্তু ওপেনার দুজনের এক জন বিদায় না হলে তো মাঠে নামার সুযোগ নেই। এ দিকে দুজনের কারুরই আউট হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অধৈর্য পলি অবশেষে আমাকে চিরকুট পাঠায়। অনবরত মারতে গেলে কোনও না কোনও সময় ভুল হবেই। ফলে উইকেট খুইয়ে বসব। মহামান্য ক্যাপ্টেনের মাঠে নামার সুযোগ ঘটবে।’
বোঝাই যাচ্ছে, সাফল্যের সফেন বুদবুদে ছন্দপতন ছিল। সেটা পঙ্কজ বয়েও বেড়িয়েছেন আজীবন। ৪১৩-র ফুলের জলসায় চিরকুটের কণ্টক দংশন! নিজের লেখায়, ‘ক্রিকেটজীবনে পাওয়া যে সমস্ত দুঃখ আমি চিরকাল মনে রাখব এটা তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম।’

যে বই থেকে: ‘পঙ্কজ’, গৌতম ভট্টাচার্য, সম্পাদনা প্রণব রায়, দীপ প্রকাশন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.