বিকেল যেই সন্ধের দিকে ঢলল, অমনি পতঙ্গের মতো মহিলাকুল ধেয়ে চলল টিভি পর্দার দিকে।
কীসের টানে? গল্পের? না কি, নিজের নিজের দমচাপা দৈনন্দিনটাকে দেখে নেওয়ার? লিখছেন
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায় |
গোলগাল লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো মুখখানি। এক ঢাল মেঘমেদুর চুল ঘিরে আলগা ঘোমটা তোলা। তেলতেলে মুখে মাখামাখি বিষাদ। প্রাণপণে লুকোনোর চেষ্টা করছে উথলে ওঠা কান্নাটাকে। দাঁত চেপে লড়াই করছে নিজেকে আদর্শ পুত্রবধূ প্রমাণ করার। আর চব্বিশ থেকে বত্রিশ ইঞ্চিতে সেই লড়াই দেখতে দেখতে ভারী হচ্ছে ড্রয়িং রুমের বাতাস। চূড়ান্ত টেনশন আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই আচমকা স্টিল চরিত্ররা। আপশোসের ঝড়, আর গজগজানির মধ্য দিয়ে আজকের মতো সিরিয়াল শেষ। ফের একটা গোটা দিনের অপেক্ষা। নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই শুরু হওয়া কী-হয়, কী-হয় ভাব। কী হবে আজ? ‘অত কষ্ট করে যে রাঁধল, সব টান মেরে ফেলে দেবে গো?’ ‘নাতির মুখ দেখতে পায়নি বলে একেবারে বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে?’ ‘কী কপাল মেয়েটার!’ বেশি ক্ষণ অবশ্য একটা নিয়ে আলোচনা চলে না, মানে চলতে পারে না। ওই বিরতির সময়টুকুই যা! তার পর তো ফের অন্য গল্প, অন্য পারিবারিক চিত্রনাট্য।
এই আমাদের সোপ-দুনিয়া। বিকেল যেই সন্ধের দিকে ঢলল, অমনি পতঙ্গের মতো মহিলাকুল ধেয়ে চলল টিভি পর্দার দিকে। দুনিয়া জুড়ে ঘনিয়ে আসা মন্দা চুলোয় যাক, পেট্রোলের দাম আকাশছোঁয়া আমার কী, সারা বিকেল টিভি গাঁকগাঁক শুনে ছেলের রেজাল্ট খারাপ হবেই তো, নিজে পড়ে না যে এমত বহুবিধ অজুহাতে জগৎসংসার ভুলে নায়িকাদের মুখে কান্নার মাখামাখি আর শ্বশুরকুলের প্যাঁচ কষা দেখতে দেখতে আবেগে থরো থরো হই আমরা।
না কি, নিজেদেরও কোথাও মিলিয়ে দিই সেই চরিত্রগুলোর সঙ্গে? সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ফুরফুরে তুরতুরে নির্ভার মন হঠাৎই যেমন বদলে যেতে শুরু করে বউভাতের পরের দিনটা থেকে। |
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সহ্য করা, আর মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষাটাকে হাতেকলমে প্রয়োগের সময়টা যেন আচমকাই চলে আসে মেয়েদের জীবনে। আর সেই শিক্ষা সার্থক করে তুলতে একের পর এক হাড়িকাঠে উঠতে থাকে নিজের পছন্দ, ইচ্ছে, স্বপ্ন, ভাল-লাগা, ভালবাসা। হ্যাঁ, গালভরা আপ্তবাক্য একখানা আছে বই কী! ‘সংসারকে সুখী করতে হলে দু’তরফকেই কিছু কিছু জিনিস ছাড়তে হবে।’ কিন্তু নিজের আশৈশব পরিচিত ঘেরাটোপ ছেড়ে অন্য জগতে পা রাখাটাই তো মেয়েদের সবচেয়ে বড় ত্যাগস্বীকার। এর তুল্য অন্য কিছু হতে পারে কী! শুধু কি এটুকু? অপরিচিত মানুষদের নিজের বলে ভাবতে শেখা, নতুন বাড়ির নিয়ম যথাসম্ভব মেনে নেওয়া, দু’বাড়ির কর্তব্য সমান ভাবে পালন করা পাল্লা ঝুঁকল কোন দিকে?
মহিলামহলে বিপুল জনপ্রিয় ছোটপর্দাতেও বার বার সেই ত্যাগস্বীকারেরই জয়গান। যে যত কৃচ্ছ্রসাধন করবে, সে তত ভাল বউ। আঠারো থেকে আশি দর্শকদের চোখের মণি। কী মনে হয়? সমাজ পিছিয়ে পড়ছে? উঁহু, এগিয়েছে তো বটেই। বোর্ডের পরীক্ষায় মেয়েদের পাশের হার ক্রমবর্ধমান, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরে ভর্তির লাইনে মেয়েদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো, ক্ষেত্রবিশেষে ছেলেদের থেকেও বেশি, কর্পোরেট অফিসে কর্মরত-রতাদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। এ সব দেখে গর্বে বুক এত্তখানি। অহো, কী বিপ্লবই না করে ফেলেছি!
দাঁড়ান দাঁড়ান, একটা রিয়েলিটি ব্রেক নেওয়া যাক। পরিসংখ্যান ছেড়ে এক বার ভাল করে সমাজটার দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। কোন ছবি দেখব আমরা? স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হয়েও বিয়ের পর আজন্মলালিত স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয় সাধারণ পরিবারের কত মেয়ে? আর সন্তানের জন্মের পর? হিসেব নেই। কারণ, শিক্ষিত করায় দায়িত্ব শেষ সমাজের। তার পরের খবর রাখে না কেউ। রাখার প্রয়োজনও হয় না। জমি তো গড়ে দিয়েছি। লড়াই করবে, কি ময়দান ছাড়বে, সে তোমার বিবেচনা।
আর ঠিক এইখানেই মজাটা। লড়াই করার হাতটাই তো মেয়েদের অকেজো করে দেওয়া হয়। পাছে সেই হাত দিয়ে সে আঁকড়ে ধরতে চায় নিজস্বতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা। কারণ, আধুনিক পৃথিবী যত ঘরের দিকে এগিয়ে আসে, ততই তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রক্ষণশীলতা আরও চেপে বসে এক জেনারেশন আগের মানুষগুলোর মধ্যে। ভয়ঙ্কর এক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে তারা। যদি মূল্যহীন হয়ে পড়ে সংসারে? যদি হাত থেকে বেরিয়ে যায় নিয়ন্ত্রণের রাশ? পরবর্তী প্রজন্মকে তাই প্রাণপণে পিছনে টানতে থাকে। নিজের ছেলেমেয়ে হাত ফস্কে বেরিয়ে যায় তো যাক। বাড়ির বধূরা যেন বেরিয়ে না যায়। তারাই তো গড়বে নতুন সংসার, আগলে রাখবে পুরনো মূল্যবোধ। ‘আদর্শ বউ’-এর নিত্যনতুন সংজ্ঞা বের করে, যাতে কোনও ভাবেই ‘ইন্ডিভিজুয়ালিজম’ শব্দখানা অল্পবয়সি বউটির কর্ণকুহরে সেঁধোতে না পারে। ফতোয়া বসে পোশাকে, অবাধ ঘোরাফেরায়, পছন্দমত পেশা বেছে নেওয়ায়, এমনকী সময় সময় ভাবনায়ও। পাছে কোনও ফাঁকতালে সে পেয়ে যায় চোখে চোখ রাখার সাহস, এক লহমায় উড়িয়ে দেয় এত দিন শেকড় গেড়ে বসে থাকা সংস্কারগুলোকে? আর যারা রক্ষণশীলতার বাঁধন কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, এরা ভুরু কুঁচকে তাকায় তাদের দিকে ‘ও ঠিক সংসার করার মেয়ে নয়’।
তবে ছোটপর্দার সঙ্গে বাস্তবের প্রধান তফাতটা হল, সেখানে নায়িকার জীবনে বিয়ের পরের পরিবর্তনটা ঘটে রাতারাতি, দুম করে। উচ্ছল, ছটফটে কিশোরী হঠাৎই মাথায় ঘোমটা তুলে বোবা কান্নায় গুমরে মরে। আর বাস্তবের আত্তীকরণ ঘটে ধীরে ধীরে। সময় নিয়ে তাকে মজিয়ে দেওয়া হয় সংসারের পাকেচক্রে, যাতে সংবাদপত্রের পাতায়ও সে অবিরাম খুঁজে চলে ছেলের টিফিনের জন্য নিত্যনতুন রেসিপি। আর ধুলোর পরত পড়ে খাটের নীচে রাখা হারমোনিয়ামে, ঘুঙুরগুলো হারিয়ে যায় এ তাল-বে তাল জিনিসের ফাঁকে। গলা সাধার সময় তো বরাদ্দ ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করায়। আর ঘুঙুর বাঁধার পরই কেন যে বার বার অতিথিরা কড়া নাড়ে, চা খাওয়ার ইচ্ছে জাগে শ্বশুরমশাইয়ের!
এই মেয়েরাই এক দিন হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পায় সিরিয়াল-এর গপ্পে। নিজের জীবন আর পর্দার নায়িকার জীবন তখন মিলেমিশে এক। ফেলে আসা সময়গুলো আয়না হয়ে ফুটে ওঠে তার চোখের সামনে। যত ক্ষণে সেই নায়িকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায়, তত ক্ষণে মন ঘুরে গিয়েছে মেয়েদের চিরন্তন লড়াইয়ের অন্য এক গল্পের দিকে। আর সেই মন নিয়েই বরের হাতে মার খাওয়া কাজের মেয়েটির ব্যথায় কাতর হয়ে সে মারের দাগে মলম ঘষে। বড় জোর বরকে ডেকে ধমক। শিউরে উঠে বলে না, ‘ওরে পালা। এ ভাবে প্রতি দিন মরিস না। নিজের জোরে বাঁচ’।
নারীদিবস, মেয়েদের নিয়ে সেমিনার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে লেখা বরং তোলা থাক বাঁধন কেটে বেরিয়ে যাওয়া কন্যেদের জন্য। বাকিরা আসুন সবাই মিলে টিভির পর্দায় চোখ রাখি। পরবর্তী পর্বের দিকে। |