একটি জলসায় তারস্বরে মাইক বাজিতেছিল রাত্রি বারোটার পরেও। কিছু বাসিন্দার অভিযোগে তাহা থামাইতে আসিল পুলিশ। প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ থানা ঘিরিয়া ধরিলেন ও ভাঙচুর চালাইলেন, কয়েক জন পুলিশ আহত হইলেন, জানালার কাচ ও পুলিশের গাড়ি, সকলই ভাঙিল। ঘটনাটি ঘটিল গত বৃহস্পতিবার, পশ্চিমবঙ্গে। এই ঘটনা অন্য মাত্রায় ও তীব্রতায় ঘটিয়া চলিয়াছে রাজ্য জুড়িয়া। যে কোনও ধর্মীয় পার্বণের সহিত আমরা একটি করিয়া জলসা জুড়িয়া দিতে বড় ভালবাসি, আর তাহা গভীর রাত্রি, এমনকী ভোর অবধি চতুষ্পার্শ্ববর্তী সকল প্রাণীর কর্ণপটহ বিদীর্ণ করিয়া না চলিলে আমাদের মন উঠে না। যে মানুষ ইহার প্রতিবাদ করেন, তাঁহাকে আমরা রসভঙ্গকারী শয়তান বলি এবং অচিরেই জনক্ষোভ উঁহার বিরুদ্ধে ফাটিয়া পড়ে। এলাকা অভিজাত হইলে, ব্যাপার হিংসাত্মক কর্ম অবধি গড়ায় না, কয়েকটি খর মন্তব্যে ইতি হয়। না হইলে, ইষ্টক ও লাঠির ব্যবহার শুরু। পুলিশ বাধা দিতে আসিলে তাহাকে উচিত শিক্ষা দিয়া সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে সম্মান দর্শানো হইয়া থাকে। সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রে এক অতিশয় পবিত্র স্থান অধিকার করিয়া আছেন। তাঁহারাই তো নির্বাচন করিয়া সরকারকে আনিলেন, অতএব তাঁহাদের ইচ্ছাকে তাবৎ প্রশাসন আদেশ হিসাবেই দেখিতে বাধ্য, এমত ধারণা তাঁহাদের অহংকে স্ফীত করিয়াছে। অধিকাংশ মানুষ যাহা চায়, তাহাই ঘটিবে এবং তাহা স্বতঃই ন্যায়কর্মের সম্মান পাইবে: এই ‘সংখ্যাধিক্যে সকলই সিদ্ধ’ তত্ত্ব অনেকেই বিশ্বাস করেন। ‘দশে মিলি করি অকাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ সূত্র তাঁহাদের পুলকিত রাখে এবং কালীপূজায় নিরন্তর পৈশাচিক শব্দ করিবার কালেও ভরসার জোগান দেয়।
মূল কথাটা শব্দ লইয়া নয়, সভ্যতা লইয়া। আমার নিজ আনন্দবিধানের জন্য যাহা ইচ্ছা করিবার অধিকার আছে, তত ক্ষণ, যত ক্ষণ তাহা অন্যের নিরানন্দের কারণ হইয়া না দাঁড়াইতেছে। ইহা সভ্য সমাজের মূল নীতিগুলির অন্যতম। আমার স্বাধীনতার অধিকারের সঙ্গে সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্য ভাবে অন্যের স্বাধীনতাকে সম্মান করিবার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত হইয়াছে। সংগীত শ্রবণ করিবার অধিকার যেমন প্রতিটি মানুষের রহিয়াছে, তাহা না শ্রবণ করার অধিকারও প্রতি মনুষ্যের রহিয়াছে। এই সহজ কথাটি অধিকাংশের নজর এড়াইয়া যায়। পথ রোধ করিয়া ও জনজীবন তছনছ করিয়া উৎসব পালন করিবার দেশে, সমষ্টিগত ইতরতার উপর নির্ভর করিয়া বে-আইনে রাস্তা পার হইবার ও সর্বত্র নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিবার দেশে, অনেকেই অসভ্যতাকে জন্মগত অধিকার হিসাবে গ্রহণ করেন ও তাহা প্রয়োগের সময় উদ্যম ও মদমত্ততার অবধি থাকে না। আমি গান শুনিব বলিয়া অন্য মানুষের নিদ্রা যাইবার অধিকার নাই, আর সে তাহা বলিলে তাহার পৃষ্ঠের চামড়া তুলিয়া লইবার অধিকার আমার আছে, ইহা আসলে গণতন্ত্রের অজুহাতে মস্তানতন্ত্রের উপাসনা।
এই উপাসনার আর এক উপাদান: ধর্ষকাম। সহস্র চকোলেট বোমে অগ্নিসংযোগের উদ্দেশ্য কেবলই কি নিজে আনন্দ লাভ করা? উহা অন্যদের সাতিশয় পীড়িত করিবে, এই নিশ্চয়তা না থকিলে আমোদ বহুলাংশে কমিয়া যাইত না কি? জলসা নাহয় সংগীতানুরাগের পরিচয়, কিন্তু ওই গানগুলি মাইকের সাহায্যে অসহ্য জোরে বাজানোর মূল মজা কি অন্যের কানে জোর করিয়া তপ্ত শলাকা প্রবেশ করানো নহে? জলসায় বাধা দিয়াছে বলিয়া থানা ঘিরিয়া ফেলিবার মধ্যে কাচ ভাঙিবার ঝনঝন ও মাথার খুলি ফাটিবার ফটাফট ধ্বনি শুনিবার হ্লাদিত প্রত্যাশাও কি থাকে না? হয়তো দৈনন্দিন জীবনে আমাদের প্রবল বেদনা বর্তমান, তাই অবদমিত ক্রোধ মলের ন্যায় বাহির করিয়া দিতে আমরা অতীব আরাম পাই। জলসার পরবর্তী প্রহার-পর্ব হয়তো বহু মানুষের নিকট অধিক আনন্দময় জলসা হইয়া প্রতিভাত! |