|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ৩... |
|
নতুন ভাবনা, কথা হোক |
বিশ্বজিৎ রায় |
বয়সে পিঠোপিঠি। থাকতেনও কাছাকাছি। দুজনেরই খ্যাতি দেশে-বিদেশে। যাকে বলে কমনফ্রেন্ড তা-ও দুজনের ছিল। তবু রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের মধ্যে পরিচিতি থাকলেও সখ্য গড়ে ওঠেনি। বিবেকানন্দ দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন না। রামকৃষ্ণদেবের দেহাবসানের পর তাঁরই শ্রমে, পরিকল্পনায় ও অন্য গুরুভাইদের সহায়তায় গড়ে উঠল রামকৃষ্ণ মঠ-মিশন। শুধু বৈরাগ্যসাধন নয় জীবসেবার আদর্শে বিশ্বাসী এই সন্ন্যাসীদের সংঘ। দেশের উন্নতি, সমাজের মঙ্গল, মানবতার প্রচার তাঁদের লক্ষ্য। এ দেশের অন্য প্রদেশের মানুষেরা এবং বিদেশের আগ্রহীজনেরা এই কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছিলেন। আমেরিকায় ও ইংল্যান্ডে বিবেকানন্দ তাঁর অনলস বক্তৃতায় নিজের দেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মের কথা ইতিবাচক ভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯০২-এ যখন চল্লিশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর প্রয়াণ হল, তার পরেও রবীন্দ্রনাথ আরও ঢের দিন এই পৃথিবীতে। চিন্তার নানা পর্ব ও পর্বান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে, সমাজ-দেশ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করেছেন। বিবেকানন্দ আরও জীবনের অধিকারী হলে তিনিও চিন্তার নানা বাঁক অতিক্রম করতেন। হয়তো যে সখ্য সম্ভব হয়নি কবির সঙ্গে তা রূপ লাভ করতে পারত সৌহার্দ্যের।
কী হত অনুমান করে লাভ নেই, কী হয়েছে তা বাঙালির আগ্রহের বিষয়। কেন সিমলার দত্তদের ছেলেটির সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের রবির দূরত্ব রয়েই গেল তা নিয়ে বাঙালি মুখরোচক আলোচনা করতে ছাড়ে না। প্রেমিক কবির সঙ্গে কৌপীনসম্বল সন্ন্যাসীর মিল হবার নয় এমন কথা ঠারে ঠোরে উঠে পড়ে। রবীন্দ্রকবিতার আধভাঙা লাইন বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয় বলে রকের বাঙালি বিবেকানন্দের সঙ্গে কবিগুরুর বিচ্ছেদ ঘটান। এরই মধ্যে উঠে পড়ে নিবেদিতা প্রসঙ্গ। বাংলা ভাষায় কবি ও সন্ন্যাসীর সম্পর্ক নিয়ে গুরুগম্ভীর কাজ অবশ্য হয়েছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসু খানিকটা আলোকপাত করেছিলেন। দেবাঞ্জন সেনগুপ্তের লেখা হাল আমলে বাঙালি পাঠক বেশ মন দিয়েই পড়েছেন। তবে রবীন্দ্র-বিবেকানন্দ সম্পর্ক তো কেবল ঘটনা আর ব্যক্তি পরম্পরার ওপর নির্ভরশীল নয়।
গাঙ্গেয় মুখোপাধ্যায় তাঁর অ্যান অলটার্নেটিভ আইডিয়া অব ইন্ডিয়া / টেগোর অ্যান্ড বিবেকানন্দ (রুটলেজ) বইতে এই দুই চিন্তকের ভাবনাসূত্রকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বুঝতে চেয়েছেন। জাতি, ধর্ম, বৈশ্বিকতা এই বর্গগুলির নিক্তিতে বিচার করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের মানস ভূগোল। আবেগপ্রবণ বিবেকানন্দ কোনও সুপরিকল্পিত রাজনৈতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। ধর্মকে সামাজিকতার পরিসরে প্রয়োগ করে মানবকল্যাণ চেয়েছিলেন তিনি, যা জাতি-রাষ্ট্রের সীমায় আচ্ছন্ন নয়। রবীন্দ্রনাথও রাষ্ট্রীয়তার সীমা সম্বন্ধে সচেতন। হালে তো জাতি-রাষ্ট্রের সীমা নিয়ে নানা কথা উঠছে। গাঙ্গেয় যে কথাগুলি ভাবাতে চেয়েছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি আরও খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। কাজ, প্রেম, নারীত্ব, পৌরুষ এই নিয়ে দুজনের ভাবনা কী ছিল ব্যবহার করা যেতে পারে তা-ও। কথা শুরু হোক। |
|
|
|
|
|