|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
যেন এক অন্য হ্যামলেট |
নাটক দেখে এসে এমনই অভিজ্ঞতা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। |
ডেনমার্কের রাজা ক্লডিয়াস সিংহাসনে। উপস্থিত পারিষদবর্গ। রাজার পাশে মহারানি গারট্রুড। ক্লডিয়াস পারিষদদের উদ্দেশে বলছেন, “হ্যামলেট আমার অগ্রজ, মাত্র কয়েক দিন হল পরলোক গমন করেছেন। আমরা এখনও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু আমাদের নিজেদের কথাও আমরা ভুলে যাইনি। সে কারণে মাত্র কয়েকদিন আগেও যিনি আমার ভ্রাত্ৃবধূ ছিলেন আজ তিনিই রাজমহিষী হয়ে আমার পাশে। আমার দাদার মৃত্যুতে রাজ্যে এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা।” রাজা ক্লডিয়াস এ বার তরুণ হ্যামলেটের দিকে তাকালেন, “পুত্রবৎ হ্যামলেট, তোমাকে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?” হ্যামলেটের মা, ডেনমার্কের বর্তমান রানি গারট্রুড হ্যামলেটের মন থেকে বিষণ্ণতা দূর করার জন্য বললেন, “তোমার আর মৃত পিতার কথা চিন্তা না করে স্বাভাবিক হওয়াই দরকার। জানোই তো, বীরের মৃত্যুই সত্য। একে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়াটাই সঙ্গত।” উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ পৃথিবীজোড়া অনুবাদ রূপান্তর প্রতিগ্রহণ। নাটকের এই ছবিটুকু মোটামুটি মনের মধ্যে আঁকা ছিল কৈশোর থেকে। অন্য থিয়েটারের প্রযোজনায় বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় যে ‘হ্যমলেট’-এর অভিনয় দেখে এলাম, তা আমার সেই চেনা ছবিকে অবিকৃত রেখে উন্মোচিত করল এক অন্য হ্যামলেটকে। অন্য রঙে, তুলির অদৃশ্য নানা টানে, পরতে পরতে রূপ পেল এক ভিন্ন হ্যামলেট। যা একই সঙ্গে মৌলিকতার ও সৃজনশীলতার মিশেল। এক দিকে চিরন্তন লোভ আর ক্ষমতার দম্ভ, অন্য দিকে ষড়যন্ত্র স্বার্থপরতার ফাঁদে আটকে পড়া বিবেকবান মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব। কোনও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই হ্যামলেট বাঁধা নয়।
পার্কস্ট্রিটের পানশালা যা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে বন্ধ ছিল বহু দিন, তেমনই এক পটভূমিতে নাটকটি শুরু। তার বারকাউন্টার, পাশের সিঁড়ি, ওপরের ডেক, আপনি খোলে এবং বন্ধ হয় এমন একটি দরজা সবই এই নাটকে এক একটি চরিত্র হয়ে হ্যামলেটের পাশে এসে দাঁড়ায়। |
|
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অভিনীত হ্যামলেটের মধ্য দিয়ে শুধু ডেনমার্কের রাজপুত্রকেই নয়, তুলে ধরেছেন যে কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষোভ-সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ণ যে কোনও হ্যামলেটকে। হ্যামলেট চরিত্রের নানা ‘শেডস’ তার পাগলামি, তার প্রতিরোধস্পৃহা, তার বেপরোয়া প্রেম, ভাবালুতা সুরজিৎ তাঁর কণ্ঠের উত্থান-পতনে, দূরত্ব মাখানো দ্রুত উচ্চারণে, স্বরক্ষেপণের সঙ্গে শরীরী ভাষার মেলবন্ধনে হ্যামলেট চরিত্রের অস্থিরতাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মেলে ধরেছেন।
কাকা ক্লডিয়াসের ভূমিকায় গৌতম দে-ও রাজকীয়। রানির চরিত্রে নন্দিনী এবং দ্যুতির ওফেলিয়াকেও চমৎকার মানিয়ে গেছে। পোলোনিয়াস শ্যামল চক্রবর্তী, লেয়ার্টেম দেবাশিস রায়চৌধুরী দু’জনেই যে দক্ষ অভিনেতা তার প্রমাণও তাঁরা রেখেছেন। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় কবর খননকারী কমল চট্টোপাধ্যায়ের নাম। এই নাটকে দর্শক হিসাবে মঞ্চে কিছু মূক মানুষের উপস্থিতি নজরে পড়ে। পোশাকের সামান্য পরিবর্তনে পানশালার ওয়েটার বা রাজার সৈন্য হয়ে এঁরা মাঝে মাঝেই কোনও না কোনও চরিত্র হয়ে হাজির হন। বাকি সময় তাঁরা শুধুই মূক দর্শক। শক্তি বিশ্বাসের অনুবাদ, সৌমিক-পিয়ালীর মঞ্চ, জয় সেনের আলো, অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের আবহ এবং এখনকার চালু পোশাকের সঙ্গে একটা ভিনদেশি জামা মিশিয়ে অবন্তী চক্রবর্তীর পোশাক পরিকল্পনা এই সবই এই নাটকের সম্পদ। এই নাটক দেখতে দেখতে ‘স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে।’ |
|
|
|
|
|