গার্লফ্রেন্ড ওয়ান, না গার্লফ্রেন্ড টু?
বয়ফ্রেন্ড ওয়ান, না বয়ফ্রেন্ড টু?
বিয়ে না পরকীয়া?
ইত্যাদি প্রকৃতি বিবিধ সমস্যা নিয়ে ইদানীং কালের বাংলা ছবি খুব ভাবিত থাকছিল। এ বার তাতে একটা রদবদল হল।
দুই সন্তানের মধ্যে এক জনের প্রাণ বাঁচানো যাবে, এই রকম একটা সিদ্ধান্তের মুখোমুখি যদি দাঁড়াতে হয় স্বয়ং মা-কে, চয়েজ-এর প্রশ্নটা এক ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়ে যায়। রিংগো-র নতুন ছবি ‘ন হন্যতে’ সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তের কাহিনি।
ছবির পোস্টারে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে, ছবিটি ‘মৈত্রেয়ী দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে নয়’। তার সঙ্গে আর একটা লাইন জুড়ে দেওয়া যেতে পারত, ‘চিনের কাহিনিচিত্র আফটার শক অবলম্বনে।’ রিংগো লিখেছেন, ছবিটা জিয়াং লিং-এর লেখা ‘দ্য গ্রেট তাংশান আর্থকোয়েক’ থেকে অনুপ্রাণিত। খালি চোখে দেখা যাচ্ছে, ‘ন হন্যতে’-র গল্প থেকে শুরু করে, বেশ কিছু দৃশ্য, এমনকী কিছু ডিটেলের কাজও জিয়াওগাং ফেং-এর ছবি, ‘আফটার শক’ (২০১০) থেকে হুবহু তুলে নেওয়া। এতটাই হুবহু যে, ছবিটা দেখতে দেখতে আব্বাস কিয়েরোস্তামি-র ‘সার্টিফায়েড কপি’ ছবিটার কথাও মনে পড়ে গেল। সেই ছবিতে এক জন আর্ট ক্রিটিকের চরিত্র ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পে অথেন্টিসিটি বলে কিছু হয় না। যে কোনও ‘নকল’ই নিজের মতো করে ‘আসল’ আর ‘আসল’টাও কারও না কারও ‘নকল’!
সুতরাং আসলি-নকলি নিয়ে ভ্যালু জাজমেন্টে না গিয়ে আমরা বরং ‘ন হন্যতে’ নিজের মতো করে কতটা আসল, সেটাই দেখার চেষ্টা করি।
মূল প্লটটা হল, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়েছে দুই খুদে ভাইবোন। মাকে বলা হল, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে যে কোনও এক জনকে বাঁচানো যাবে। মা বললেন, ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখো! ধ্বংসের গভীরে শুয়ে সে কথা শুনতে পায় মেয়ে। কিন্তু তার পর প্রায় অলৌকিক ভাবেই বেঁচে যায় সে! মনের মধ্যে গাঁথা থাকে, মায়ের মুখে শোনা মৃত্যু পরোয়ানা। |
আফটার শক ছবিতে ঘটনার কেন্দ্রে ছিল, ১৯৭৬ সালের তাংশান ভূমিকম্প। মেয়েটি বড় হয়েছিল ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া একটি সেনা-দম্পতির পরিবারে। দু’জনের আবার দেখা হল আর এক ভূমিকম্পের পর, ২০০৮-এর সিচুয়ান। রিংগোর ছবিতে ভূমিকম্প নেই। আছে একটি বড় কোয়ার্টার ভেঙে পড়ার ঘটনা। যদিও যে বিশালতায় সেই ধ্বংসের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তাকে ভূমিকম্পের ছবি বলেও মনে হতে পারে অনায়াসে। ডিজাস্টার-মুভি হলিউডের একটা পরিচিত এবং জনপ্রিয় ঘরানা। বড় বাজেট এবং প্রযুক্তির দেখনদারি সেখানে খুব বড় ভূমিকা নেয়। সেই নিরিখে বিপর্যয়ের দৃশ্যায়নে রিংগো বাহবা পাবেন। যদিও ছবির শেষ ভাগে বিমান ভেঙে পড়ার যে ধ্বংসচিত্র, সেটা ততটা সুনির্মিত নয়। তাতে অবশ্য বিরাট কিছু যায় আসে না। কারণ ‘ন হন্যতে’ কোনও ডিজাস্টার-মুভি নয়। ‘ন হন্যতে’ আসলে কয়েকটা মানুষের গল্প। পরিবারের গল্প। সমস্তিপুরের একটা শ্রমিক পরিবারকে নিয়ে ছবি শুরু হয়েছিল। সেখানে ছিল বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে। বাবা (শঙ্কর দেবনাথ) বাঁচল না। মা (রূপা গঙ্গোপাধ্যায়) জানল, মেয়েও বেঁচে নেই। মায়ের সম্বল বলতে রইল, ছেলে (রাহুল)। আপদেবিপদে পাশে থাকল প্রতিবেশী গোবিন্দ (চিরদীপ মিত্র)। মেয়েটা (সায়নী দত্ত) বড় হল সন্তানহারা, ভিনধর্মী এক ডাক্তার পরিবারে (দেবশঙ্কর হালদার ও চৈতী ঘোষাল)।
মেয়ের ভূমিকায় নবাগতা সায়নীর কাজটা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তিনি যথেষ্ট পরিণত বোধের ছাপ রেখেছেন। সুযোগ পেলে শক্তিশালী অভিনেত্রী হয়ে ওঠার মতো ক্ষমতা তাঁর আছে বলে মনে হয়। বাবার ভূমিকায় ভাল লাগে দেবশঙ্করকে। দেখতে গেলে তিনিই এ ছবির সব চেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র। চমকে দিয়েছেন নবাগত চিরদীপ। রূপার পাশে মাঝবয়সি গোবিন্দর ভূমিকায় তিনি পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। তবে সব চেয়ে বেশি মায়া যিনি কেড়ে নিয়েছেন, তিনি রাহুল। সাদা মনে কাদা নেই গোছের চরিত্র। রাহুল আর রূপা, মা-ছেলের অংশগুলোই ছবিতে সবচেয়ে প্রাণবন্ত হয়ে থেকেছে। ছোট্ট উপস্থিতি, তবু মনে থাকে প্রিয়াঙ্কাকেও। দিব্যেন্দুর ক্ষেত্রে সে কথাটা বলতে পারছি না।
এ বার রূপার কথা, মায়ের কথা। ন হন্যতে-র মূল স্তম্ভ তিনি। ছবিটা দাঁড়িয়েই আছে তাঁর উপরে। যে কোনও অভিনেত্রীর কাছে এটা একটা স্বপ্নের চরিত্র হতে পারে। ইন থিওরি। কিন্তু ইন প্র্যাকটিস? সেটা কিন্তু অনেকটা পরিচালকের উপরেও নির্ভর করে। ‘ন হন্যতে’-য় টুকরো টুকরো বেশ কিছু মুহূর্ত তৈরি হয় ঠিকই। তাতে টুকরো চরিত্রগুলো অনেকটা উতরেও যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে ছবিটা তার প্রত্যাশিত অভিঘাত তৈরি করতে পারে না। আর সেটা পারে না বলে সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল চরিত্রটাই। রূপা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সেটা সবটা মেরামত করতে পারেননি।
গণ্ডগোলটা কোথায় হল? রিংগোর ছবি আগে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন। ওঁর ছবিতে কিছু মোচড় থাকে, কিছু চমকে দেওয়া ভিস্যুয়াল থাকে। কিন্তু সব মিলিয়ে ছবিগুলো কিছুতেই মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। ‘ন হন্যতে’-ও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রথমত, বেশির ভাগ চরিত্রই একটু একমেটে। গভীর কোনও দুঃখ থাকলেই যে সব মানুষ এক রকম আচরণ করবে, তা তো নয়। রূপা-সায়নী-দেবশঙ্কর-চৈতী-প্রিয়াঙ্কা, সকলেই বেশ অনুচ্চকিত টাইপ। সবাই ভারী বুঝদার, সবাই খুব ম্যাচিওর। আস্তে আস্তে কথা বলে, মোর অর লেস নীরবে কাঁদে। সবাই অব্যক্ত অভিমানী, কারও রাগ-টাগ নেই। এইটা ছবি জুড়ে একটা মোনোটোনি তৈরি করে। দ্বিতীয়ত, ভিস্যুয়াল বড় বেশি রকম দৃষ্টিনন্দন। ফ্রেম বাঁধানো। সব ক’টা চরিত্র যেখানে ডিপ্রেসড, বাস্তবটা যেখানে নির্দয়, সেখানে ভিস্যুয়ালে কোনও রুক্ষতা নেই, অনৌজ্জ্বল্য নেই। অনেকটা যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে দুঃখের গান চালিয়ে ক্যান্ডললাইট ডিনার করার মতো।
গানের কথা যখন উঠল, এ ছবিতে বেশির ভাগ গানই নেপথ্যে ব্যবহৃত। শ্রীরাম ইউসুফের সঙ্গীত আলাদা করে খুব কোনও মাত্রা যোগ করতে পারেনি। আর একটা কথা, বেশি বয়সের সায়নীকে একাধিক দৃশ্যে ভারী জ্যাকেট জাতীয় পোশাক পরতে দেখলাম। বাকিরা নরমাল পোশাকে। শীত-গ্রীষ্ম গুলিয়ে যাচ্ছে যে!
সব কিছুর পরেও শুধু কাহিনিগুণেই ‘ন হন্যতে’ স্মরণীয় হতে পারত, যদি আসলি-নকলির গল্পটা সেখানে না থাকত! সরি সরি, এই নিয়ে ভ্যালু জাজমেন্টে যাব না বলেছিলাম! ভুল হয়ে গেছে বিলকুল! |