|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ২... |
|
অঞ্জন দত্তের সেরা ছবি |
এ যেন আমাদেরই জীবনের গল্প। জাগিয়ে তোলে বুদ্ধিবৃত্তি,
শিল্পচেতনা, মানবিক বোধ। লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রথমেই ‘দত্ত vs দত্ত’ দেখার মিশ্র প্রতিক্রিয়াটি কী সেটা একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। প্রতিক্রিয়া নম্বর একউচ্ছ্বাস!
প্রথম থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ক্রমাগত অনুধাবন করতে করতে হল থেকে বেরিয়ে ফেটে পড়ার ‘ইচ্ছে’। ‘হোয়াট আ গ্রেট সিনেমা!’ বাংলা সিনেমা আবার এই রকম একটা মহৎকে ছুঁয়ে এল? মাল্টিপ্লেক্স থেকে বেরোতে বেরোতে সহদর্শকের সঙ্গে আনন্দে করমর্দন, কোনও এক অচেনা মাসিমার পিঠে হাত, একটা পেপার ন্যাপকিন এক তরুণীর জন্য যাকে তার বয়ফ্রেন্ড করিডরের এক কোণে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
উচ্ছ্বাস! এ আমার সিনেমা। আমাদের সিনেমা। যারা ভাল কিছু সাহিত্য পড়েছি, কিছু ভাল সিনেমা দেখেছি, যাদের মাথাটা এখনও নষ্ট হয়নি। ভাল খারাপের তফাতটা যারা বুঝি, নিশ্চয়ই বুঝি! এই উচ্ছ্বাস সিনেমার জন্য সিনেমার প্রতি।
আর প্রতিক্রিয়া নম্বর ২বিষণ্ণতা! সিনেমার জন্য, সিনেমার প্রতি মাত্র নয়। সেই গল্পটার ভেতর প্রবেশ করে গল্পের আবেগ, চরিত্রগুলোর আবেগের প্রতি সমাসক্ত হতে হতে মগ্ন হতে হতে যখন ভুলেই গেছি আমি এসেছি ছবিটা দেখে সমালোচনা লিখব বলে, আমার হাত থেকে খসে গেছে কলম, আমার চোখ খড়খড় করছে। আমি বুঝতে পারছি আমি একটা মহৎ কিছুর সামনে পড়ে গিয়েছি। মহৎ সিনেমার বা সাহিত্যের কতগুলো এপিক ডাইমেনশন থাকে। কতগুলো নীরব আঘাত থাকে, তার রসে অবগাহন করতে হলে পাঠক বা দর্শককে যেন হয়ে উঠতে হয় ‘সময়’-এর মতো, ‘কাল’ এর মতো, যেন নশ্বর মানুষ নয়, দেখছে সময়, মহাকাল আমাদের চোখ দিয়ে। ‘দত্ত vs দত্ত’র মধ্যে সেই ব্যঞ্জনাটা রয়েছে, আছে তেমন তেমন সব চরিত্র যারা নিজেরাই জানে না তারা দর্শককে আঘাত দিয়ে যাচ্ছে নিজেদের জীবনের বিনিময়ে। |
|
‘দত্ত vs দত্ত’
অঞ্জন, রূপা, পার্নো, অর্পিতা, রণদীপ |
পত্রিকার পাতাতেই দু’ সপ্তাহ আগের সাক্ষাৎকার এবং চার পাশ থেকে পাওয়া তথ্যের কারণে দর্শক জানেন যে ‘দত্ত vs দত্ত’ অঞ্জন দত্তের আত্মজীবনীমূলক সিনেমা (আত্মজীবনী জাত অভ্যুত্থানও বলা যেতে পারে)। নিজের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জন ‘দত্ত vs দত্ত’তে। এই সমালোচনা লিখতে লিখতে অঞ্জনের অভিনয়ের সঙ্গে যাঁর অভিনয়ের তুলনা টানতে ইচ্ছে হল তিনি ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ’। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’তে চপলের চরিত্রটার প্রতি ঋতুপর্ণের যে সর্বস্ব অর্পণ করা অভিনয় ছিল, অঞ্জনও নিজের পিতার চরিত্রে সেই আত্মানুসন্ধানমূলক অভিনয় করে গেলেন। মেথড অ্যাকটিং নেই, স্টাইল নেই, নিজেকে প্রয়োগ করার কোনও কৌশল যেন জানাই নেই, অভিনয় যেন অভিনেতার লীলাখেলাঅঞ্জনের অভিনয় দেখে এই কথাই মনে হল। আত্মজীবনীর অংশ বলেই কি ‘দত্ত vs দত্ত’ এতখানি জোরালো। সত্তরের দশক, উত্তর কলকাতা, কলোনিয়াল হ্যাংওভার, নকশালবাড়ি, তারই মধ্যে ঢুকে পড়েছে বব ডিলান, বিটলস্, বিলি ওয়াইল্ডার, মারিজুয়ানা। গিটার, প্রেম, যৌনতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে পূর্বের দেশাত্মবোধ, আর পরের বিপ্লবের ডাক। এই এতগুলো স্তরকে চিত্রনাট্যে গেঁথে ফেলা কখনই সহজসাধ্য হয় না। যদি না তা আত্মজীবনীর মতো প্রামাণ্য না হয়। এবং রক্তের ভেতর ঢুকে বসে থাকা অভিজ্ঞতা দ্বারা নির্মিত না হয়ে থাকে। |
|
অনেকেরই যা মত অঞ্জন দত্ত সাহস দেখিয়েছেন, নিজের জীবনকে অকপটে সততার সঙ্গে বিবৃত করেছেন। কিন্তু ‘সাহস’, ‘সততা’, ‘অকপট’ এই বিশেষণগুলো প্রকৃতপক্ষে ‘দত্ত vs দত্ত’র পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ এরকম একটা ছবি তৈরি করতে গেলে একটা অন্যতর পদার্থেরও অনুসন্ধানী হতে হয়। যেটা হল অতীতকে রিক্রিয়েট করার আনন্দ, রোমাঞ্চ, একটা পজেশনকে সিন্দুক খুলে দেখানোর বাসনা। এই আনন্দ কখনও কখনও শিল্পীর কাছে সাহসের থেকে অনেক বড়, দ্বিতীয় একটা দর্শনও খাটতে পারে যে, তালতলার দত্তরা এই যে ভাঙতে ভাঙতে কোনও ক্রমে টিকে থাকা পরিবার, ওই যে ব্যর্থ উকিল এক পিতা, ওই জ্যাঠামশাই, চিনা, রুনু মাসি, ঘেন্টিদা, পাগল কাকা, অ্যালকোহোলিক মা, টনি এঁরা তো শুধু সত্তরের দশকে অঞ্জনের জীবনেই উপস্থিত ছিলেন না, এঁরা তো আমাদের বহুর জীবনেই নানা দশকে নানা নামে, বেশভূষায় ও মুদ্রাদোষে প্রকাশিত হয়েছেন। প্রভাব রেখে গিয়েছেন। সেখানেই তো দর্শক তালতলার দত্তদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারবেন। অনায়াসে। এই মৌলিক গুণটি ছবিটিকে সার্থক করে তোলে। অঞ্জনের টিমে যাঁরা রয়েছেন ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়, নীল দত্ত, এঁদের নিয়েই বারবার ছবি করুন অঞ্জন। তাতে কারও কোনও ক্ষতি নেই। অভিনেতা অভিনেত্রীরা প্রত্যেকে মন দিয়ে অভিনয় করেছেন, অনেক মায়া মমতা উদ্যম ঢেলে দিয়েছেন। তাঁরা তাই জ্বলজ্বল করে উঠেছেন মায়ের চরিত্রে, দাদুর চরিত্রে, ঘেন্টি কাকার চরিত্র কিংবা টনি, জ্যাঠামশাই, খোকাদার চরিত্রে। পার্নো কিংবা রূপা তো ভাল অভিনেত্রীই কিন্তু এখানে আলাদা করে ভাল লেগেছে অর্পিতাকে। রীতা কয়রাল অনবদ্য। দীপঙ্কর দে অসামান্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতি জুনিয়র দত্তের ভূমিকায় রণদীপ একদম খাপ খোলা তরবারির মতো ধারালো।
একের পর এক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ওপর তৈরি হতে থাকা ছবি দেখতে দেখতে দর্শক যখন ভাবছেন যে বাঙালির জীবনে কি এর থেকে বেশি বিপন্নতা আর কিছুতে নেই তখনই ‘দত্ত vs দত্ত’ আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, শিল্পচেতনা, মানবিক বোধ, সৃষ্টিশীলতার গরিমাকে আবার নতুন করে ঝলসে দিয়েছে সকাশে। সেদিক থেকে বিনা দ্বিধায় বলা যায় বেশ কয়েক বছরের মধ্যে ‘দত্ত vs দত্ত’ অন্যতম সেরা বাংলা ছবি। আর অবশ্যই অঞ্জন দত্তের সেরা কাজ। |
|
|
|
|
|