মমতা আছেন। একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণাও হয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাল না সিঙ্গুর।
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় বার সিঙ্গুরে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের জমি-আন্দোলনের ধাত্রীভূমিতে দাঁড়িয়ে এ দিন কোনও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেননি মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সফরসূচিতে কোনও জনসভাও ছিল না। প্রথমে ব্লক অফিসে প্রশাসনিক বৈঠক, পরে সাংবাদিক সম্মেলনে নানা প্রকল্পের ঘোষণা সেরে ফিরে গিয়েছেন তিনি। প্রতিশ্রুতির যে তালিকা শুনে প্রকল্পের ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতাদের অনেকেই বলেছেন “আগে প্রকল্প হোক। পরে দেখা যাবে। চেয়েছিলাম জমি ফেরত। সেটাই তো এখনও হল না!”
২০০৬ সাল থেকে এই নিয়ে ৪০ বার সিঙ্গুরে গেলেন মমতা। আন্দোলন-পর্বে প্রতিবারই গ্রাম ঝেঁটিয়ে মানুষ আসতেন তাঁর কাছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা এর আগে সিঙ্গুরে যান গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর। সে বারও তাঁর আসা-যাওয়ার পথে, সভাস্থলে নেমে এসেছিল জনজোয়ার। কিন্তু এ বার সেই আবেগ কোথায়! ভিড়ও সে ভাবে চোখে পড়েনি। শুধু শোনা গেল, ব্লক অফিসের বাইরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর জনসভা না থাকায় গ্রামবাসীদের ডাকা হয়নি। তাই সে ভাবে ভিড় হয়নি।
এক ঘণ্টার মধ্যে প্রশাসনিক বৈঠক (বিডিও-দের জেলা প্রশাসন এবং বিধায়কদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন, পূর্ত দফতরের রাস্তার কাজে উষ্মা প্রকাশ করেছেন) সেরে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি শুধু সিঙ্গুরের জন্য জমি ফেরত দেওয়ার ‘বিভ্রান্তিকর’ প্রতিশ্রুতি ছাড়াও আরও দু’টি ঘোষণা করেন। বলেন, “সিঙ্গুরে নতুন ডিগ্রি কলেজ হবে। তার জন্য ৫ একর সরকারি জমি দেখা হয়েছে। এ জন্য ১০ কোটি টাকা খরচ হবে। আপাতত আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে মহামায়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮টি ঘর নিয়ে চলবে কলেজ। বেড়াবেড়ির রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম বালিকা বিদ্যালয়কে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হচ্ছে।” তা ছাড়া, হুগলির সবুজদ্বীপে ‘ইকো-ট্যুরিজম’ চালু করা, ২ ডিসেম্বর পুরুলিয়ায় গিয়ে ৩১ হাজার কৃষককে সব্জি বিক্রির ভ্যান বিলি করা, রাজ্যের ৩১ হাজার গরিব কৃষককে সেচের পাম্প চালানোর বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ভর্তুকি হিসেবে এককালীন ৮ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। চলতি অর্থবর্ষে ১০০ দিনের প্রকল্পে জেলার কর্মদিবস (২৯ দিন) বাড়িয়ে অন্তত ৫০ দিন করার নির্দেশও দেন।
ব্লক অফিসে বৈঠকের পরে মমতা যখন এই ঘোষণা করছেন, তখন সেখান থেকে কিছুটা দূরে জড়ো হওয়া এলাকাবাসীর সংখ্যা হাতেগোনা। দলের একাংশের তোলাবাজি নিয়ে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সরব হওয়ার পরে এ দিনের ওই বৈঠককে ঘিরে গোলমালের আশঙ্কায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। জনতাকে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের বৈঠকে জেলার ১৮ জন বিধায়কের মধ্যে তৃণমূলের ১৫ জন হাজির ছিলেন। ছিলেন না শুধু সিঙ্গুরের বিধায়ক, পাণ্ডুয়ার সিপিএম বিধায়ক আমজাদ হোসেন এবং গোঘাটের ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক বিশ্বনাথ কারক। বাম বিধায়কেরা জানিয়েছেন, ফোনে জানানো হলেও চিঠিতে আমন্ত্রণ পাননি বলে তাঁরা বৈঠকে সামিল হননি।
মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি শুনে গোপালনগর মধ্যপাড়ার বাসিন্দা, ‘অনিচ্ছুক’ জমিদাতা পরিবারের এক গৃহবধূ বললেন, “জলের আগে ঢেউ গুনে লাভ নেই।” মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতে না পেরে ক্ষুব্ধ কোলেপাড়ার বাসিন্দা, আর এক ‘অনিচ্ছুক’ মীরা পাঁজা। তাঁর ক্ষোভ, “জমি-আন্দোলনের জন্য জেলে যেতে হয়েছিল। এ বার তো আমাদের ডাক-ই এল না। ডাকার আর মুখ নেই নেতাদের।” ওই এলাকারই বাসিন্দা সুশান্ত ধাওয়ার হতাশা, “নেতারা আমাদের আর পাত্তা দেন না। সরকার চাল-পয়সাই ঠিক মতো দিতে পারে না, আবার প্রকল্প করবে!”
ব্লক অফিস চত্বরে দাঁড়িয়ে মমতার স্মৃতিচারণ, “২০০৬-এর ২৫ সেপ্টেম্বর আমাকে এখান থেকে টেনে বার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার উপরে অনেক অত্যাচার হয়েছে। জীবন সংশয়ও হয়েছিল। তাই সিঙ্গুরে আসার ব্যাপারটা আমি ঐতিহাসিক বলেই মনে করি।”
নেত্রীর আবেগে সাড়া দেওয়ার মতো পুরনো সিঙ্গুর কিন্তু গরহাজির। |