তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর যা বলার বিকেল চারটেয় বলবেন।
শিক্ষকোচিত সময়ানুবর্তিতা বোধহয় একেই বলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩টে বেজে ৫৯ মিনিট। শিবরামবাটি গ্রামের ভটচায বাড়ির দুর্গা-দালানের দরজা খুলে গেল।
মণ্ডপের ভিতর থেকে তিনি বাইরে এলেন। পরনে ধুতি ও উলিকটের উপর জড়ানো শাল। খালি পা। নমস্কারের ভঙ্গিতে দু’হাত। জানিয়ে দিলেন শুধু মন্ত্রিত্ব ছাড়া নয়, ‘শারীরিক ও মানসিক ভাবে’ পারছেন না বলে সক্রিয় রাজনীতি থেকেই পাকাপাকি ভাবে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সিঙ্গুর-আন্দোলনের মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’ ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।
রবীন্দ্রনাথবাবুর কথায়, “আমার এখন ৮০ বছর বয়স। গত বছর বাইপাস সার্জারি হয়েছে। আমার মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের দায়িত্ব নিতে পারছি না। আমি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ও যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও আমার দলের সর্বোচ্চ নেত্রীকে চিঠি দিয়েছি।” মন্ত্রী হিসেবে তিনি আগেই তাঁর পদত্যাগপত্র মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। এ বার বিধায়ক হিসেবেও তাঁর পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথবাবু। তাঁর রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও অভিমান কাজ করছে না বলেও দাবি করেন তিনি। |
মুখে যা-ই বলুন, দলীয় নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে মতবিরোধের জেরেই তিনি আচমকা রাজনৈতিক অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন বলে প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে। প্রথমে গত ২০ নভেম্বর মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা, তার পর ২৬ নভেম্বর সংবাদমাধ্যমের কাছে দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর মুখ খোলা এবং পর দিন হরিপালের বিধায়ক ও অধুনা মন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে দিয়ে দলীয় তরফে রবীন্দ্রনাথবাবুকে প্রতিরোধ সব মিলিয়ে সিঙ্গুরের পরিস্থিতি গত ক’দিন ধরে উত্তপ্ত ছিলই।
এ দিনও রবীন্দ্রনাথবাবু তৃণমূলে দুর্নীতির প্রসঙ্গ কিন্তু ছুঁয়েই গিয়েছেন। তাঁর কথায়, “তৃণমূলের গরিষ্ঠ সংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থক এখনও সততার রাজনীতি করেন। তবে কোনও কোনও জায়গায় বিচ্যুতি ঘটতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু সে রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন।” ‘মাস্টারমশাই’ আর দলনেত্রীর মধ্যে তবে দূরত্ব কেন? রবীন্দ্রনাথ যে দিন রাজনৈতিক অবসর গ্রহণের ঘোষণা করছেন, সে দিনই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরের বিডিও অফিসে এসে প্রশাসনিক বৈঠক করেছেন। বিধায়ক হয়েও সেই বৈঠকে গরহাজির থেকেছেন রবীন্দ্রনাথবাবু। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও এক বারও উচ্চারিত হয়নি টানা তিন বার জেতা প্রবীণ শিক্ষকের নাম। এমনকী সাংবাদিকেরা এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও মমতা কোনও উত্তর দেননি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরে আসবেন আর রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সেখানে শুধু অনুপস্থিত নন, অনুচ্চারিতও থেকে যাবেন এমন ঘটনার সাক্ষী সম্প্রতি সিঙ্গুর হয়নি। কেন গেলেন না মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে? রবীন্দ্রনাথবাবুর উত্তর, “আমি যত দূর জানি, সরকারি অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতে লিখিত ভাবে আমন্ত্রণ জানানো বা বিজ্ঞপ্তি জারি করাটাই রেওয়াজ। কিন্তু আমি কোনও লিখিত আমন্ত্রণপত্র পাইনি। কেবল মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে তিন-চার দিন আগে আমাকে ফোন করে ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু মমতা নিজে বা তাঁর কোনও প্রতিনিধি মারফৎ আমাকে যেতে বলেননি। তিনি ডাকলে আমি যাব না, এমন ঔদ্ধত্য আমার নেই। কিন্তু বিনা আমন্ত্রণে আমি সরকারি কোনও অনুষ্ঠানে যেতে অক্ষম।”
রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, মন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি থেকে অব্যাহতি চেয়ে গত ১৬ নভেম্বরই একটা চিঠি লিখেছিলেন তিনি। গত ২০ নভেম্বর সেই চিঠি তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে দেন। তার কোনও উত্তর এখনও পাননি। ২১ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথবাবুকে কৃষি দফতর থেকে সরিয়ে পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা রূপায়ণ দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজ্যের প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রীর কথায়, “মমতা আমাকে বলেছেন, ‘আপনাকে ছাড়া যাবে না।’ কিন্তু আমি কোনও বিতর্ক তৈরি করতে চাই না। আমার কোনও অভিমানের প্রশ্ন নেই। মুখ্যমন্ত্রী যদি আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না-ও করেন, তা হলে আমি জানিয়ে দেব, মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।” এর পর স্পিকারের কাছেও বিধায়ক হিসেবে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বলে জানান তিনি। তাঁর কথায়, “আমি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় রয়েছি। দেখব, তাঁরা কী ভাবে আমার আবেদনে সাড়া দেন।”
এ দিন সকালেই রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর ছাড়ার পরেই তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন। আসলে সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী কী বলছেন, সেটা না-শুনে রবীন্দ্রনাথবাবু কিছু বলতে চাননি কৌশলগত কারণেই। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, মমতা যেহেতু সিঙ্গুরের বিধায়ক সম্পর্কে ভাল-খারাপ কিছুই বললেননি, সে জন্য ‘মাস্টারমশাই’-ও সৌজন্য দেখিয়েছেন। বাড়িতে বসে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার টেলিভিশনে দেখার পরে তবেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন রবীন্দ্রনাথবাবু। বলেন, “সিঙ্গুরবাসী হতাশ, এখনই এ কথা বিশ্বাস করি না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিমধ্যেই এই সরকার অনেক কাজ করেছে।”
রবীন্দ্রনাথের অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তৃণমূলের অন্য সর্বোচ্চ নেতাদের সঙ্গেও রাত পর্যন্ত যোগাযোগ করা যায়নি। তবে সিঙ্গুরে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ির আশপাশের লোকজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন সিঙ্গুরে এসেও রবীন্দ্রনাথবাবুর নাম উচ্চারণ না-করায় অজয় কর্মকার, বীরেন ভট্টাচার্যরা বলেন, “যাঁকে ধরে এই জায়গায় উঠলেন, আজ তাঁর কথাই ভুলে গেলেন? আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনেই এর ফল ভুগতে হবে।” গোপালনগর গ্রামের মধ্যপাড়ার অনিচ্ছুক কৃষক সমাপ্তি ঘোষের আশঙ্কা, “মাস্টারমশাই থাকায় তবু কিছু আশা ছিল। উনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। এখন উনিই রাজনীতি ছেড়ে দিলে আমাদের কী হবে?” |