আদালতেই বল ঠেললেন মমতা
ন্দোলনকারীদের মন বদলাতে পারে। তিনি বদলাননি!
কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনের দুই মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও বেচারাম মান্নার প্রকাশ্য দ্বৈরথ, বছরের পর বছর জমি ফেরতের অপেক্ষায় বসে থেকে অনিচ্ছুকদের ধৈর্যচ্যুতির ইঙ্গিত পরিবর্তনের পরের সিঙ্গুরে এ সবই আছে। কিন্তু সেই আন্দোলনের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর নতুন কোনও বার্তা দিলেন না! শুক্রবারের সিঙ্গুরের অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনই। সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে জমি ফিরে পাওয়ার জন্য অনিচ্ছুক কৃষকদের আরও ধৈর্য ধরতে আবেদন জানিয়ে গেলেন শুধু। আর বললেন, আদালতে ফয়সালা হলেই জমি ফেরত। যে ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিচারাধীন বিষয়ে এমন কথা কি বলতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী?
প্রশাসন ও পুলিশের কর্তা, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সিঙ্গুরের বিডিও দফতরে প্রশাসনিক বৈঠকের পরে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ফের ঘোষণা, “জমি আমরা ফেরত দেব। ক্ষমতায় এসেই সেই কাজ করেছি। জমি এখন রাজ্য সরকারের কাছে। আদালতে মামলা চলছে। আদালতে ফয়সালা হলেই জমি ফিরিয়ে দেব।”
আদালতের রায়ের অপেক্ষায় কি সত্যিই আর বসে থাকতে চায় অনিচ্ছুকদের পরিবার? সন্ধ্যার মুখে বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোপালনগর ঘোষপাড়ার বধূ চন্দনা ঘোষের প্রতিক্রিয়া, “আরও ধৈর্য? ধৈর্য ধরেই তো অপেক্ষা করে আছি এত দিন! কী ভাবে চলছে সংসারটা, আমরাই জানি।” একই জায়গায় সমাপ্তি ঘোষের প্রতিক্রিয়া আরও তীক্ষ্ন এবং অবধারিত। “আদালতে ফয়সালা আমাদের পক্ষেই হবে, তার কী মানে আছে! এক বার রায় হলেই মামলা কি মিটবে? তার চেয়ে এখন জমির টাকা দিয়ে দিলে মিটে যায়!” অধিগৃহীত জমির জন্য ক্ষতিপূরণের চেক নেননি সমাপ্তিরা। এখন সে জন্য কী ভাবে আবেদন করতে হবে, জানতে বারদুয়েক প্রশাসনের কাছে খোঁজখবর করেছেন তাঁরা। তাঁদের বলা হয়েছে, এখন কিছু হবে না।
সিঙ্গুরে প্রস্তাবিত সরকারি কলেজের শিলান্যাস করছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুক্রবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
এই কথাটাই তো মুখ্যমন্ত্রীকে গিয়ে বলে আসতে পারতেন। জানাতে পারতেন, জমি ফেরতের অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে এ বার ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে চান। জবাবে অনিচ্ছুকদের একাংশ জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকের ধারেকাছে তাঁদের ঘেঁষতে দেওয়া হবে না, তাঁরা বুঝেছিলেন। তা ছাড়া, মুখ্যমন্ত্রীর ঘণ্টাদুয়েকের ঝটিতি বৈঠকের সময় ক্ষোভ জানিয়ে এলেও তার পরে থাকতে হত তৃণমূলের সিঙ্গুরেই! সেই ঝুঁকি তাঁরা নিতে চাননি।
মধ্যপাড়ার এক বাসিন্দার কথায়, “বলতে ইচ্ছা হয় অনেক কিছুই। কিন্তু কী ভাবে বলব?” বস্তুত, অন্ধকার গোপালনগর মোড় পেরিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় জটলায় এমন কিছু কথা কানেও এল, যার নির্যাস যাঁরা এ বিষয়ে মুখ খুলছেন, তাঁদের জীবনে আরও অন্ধকার নেমে আসতে পারে!
মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক উপলক্ষে সিঙ্গুর বিডিও দফতরের চৌহদ্দিতে ছিল আটোসাঁটো নিরাপত্তা। কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি প্রশাসন। টাটার কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় আন্দোলন-পর্বে সিঙ্গুরের দায়িত্ব সামলেছিলেন যে পুলিশ অফিসারেরা, তাঁদেরই কয়েক জনকে এ দিন ফের মোতায়েন করা হয় মমতার বৈঠক সামলানোর কাজে। তাঁদেরই এক জনের সহাস্য মন্তব্য, “দুর্দিন এলেই ডাক পড়ে!” তেমন দুর্দিন অবশ্য শুক্রবার বাস্তবে আসেনি। কারণ, অপ্রীতিকর কিছু ঘটাতে কেউ এগোয়ইনি! বরং নব্যমন্ত্রী বেচারাম মান্নার সমর্থনে স্লোগান দিয়ে দলের পতাকা হাতে হাজির ছিলেন কয়েক জন তৃণমূল সমর্থক।
সিঙ্গুরের জন্য এ দিনও কিছু ঘোষণা ছিল মমতার। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানালেন, সিঙ্গুরে নতুন ডিগ্রি কলেজ হবে। জমি ও অর্থের সংস্থান হয়েছে। বেড়াবেড়ির রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম বালিকা বিদ্যালয়কে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি শোনার পরে সিঙ্গুরের অনেকেরই মত, “চেয়েছিলাম জমি ফেরত। সেটাই তো এখনও হল না!” হতাশা কতটা বুঝিয়ে দিলেন চন্দনাদেবী: “আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আগ্রহ নেই,” বললেন তিনি।
জমি-নামা
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১
হাইকোর্ট (সিঙ্গল বেঞ্চ)
• সিঙ্গুর আইন বৈধ
২২ জুন, ২০১২
হাইকোর্ট (ডিভিশন বেঞ্চ)
• আইন অসাংবিধানিক
• মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে জমি হস্তান্তর নয়
২৪ অগস্ট, ২০১২
সুপ্রিম কোর্ট
• আপিল মামলার নিষ্পত্তি পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল
মহাকরণে মমতা
• স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আইন বৈধ
ফেসবুকে মমতা
• সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমি খুব খুশি
• এটা গরিব জমিহারাদের দীর্ঘ সংগ্রামের জের
৩০ নভেম্বর, ২০১২
সিঙ্গুরে মমতা
• জমি এখন রাজ্যের হাতে
• মামলার ফয়সালা হলেই জমি ফিরিয়ে দেব
আইনজীবী মহলে প্রশ্ন
• মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে বুঝলেন রায় রাজ্যের পক্ষে যাবে
সিঙ্গুরের যে বিডিও দফতরে এ দিন বৈঠক করলেন মমতা, তা অবশ্য তাঁর কাছে বিশেষ স্মৃতি বিজড়িত। ছ’বছর আগে ২৫ সেপ্টেম্বর এখানেই জমির চেক বিলির প্রতিবাদ জানাতে এসে পুলিশের ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়েছিল তাঁকে। মমতার কথায়, “এই অফিস থেকেই মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুজোয় চিকিৎসকেরা আমায় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। (এ দিনের) বৈঠকটা সিঙ্গুরবাসীকে উৎসর্গ করলাম।” দিনটাও স্মরণীয় তাঁর কাছে। কারণ, ২০০৬-এরই ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরে ১৪৪ ধারা দেখিয়ে ডানকুনির মাইতিপাড়া থেকে মমতাকে ফেরত পাঠিয়েছিল পুলিশ। প্রতিবাদে তৃণমূল বিধায়কেরা ভাঙচুর চালিয়েছিলেন বিধানসভার লবিতে।
পাত্র-পাত্রীদের স্মৃতির ভারও বড় কম নয়। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে সমাপ্তি বলছিলেন, “তখন এরা একদম বাচ্চা ছিল। বাড়িতে রেখে চুঁচুড়া, কলকাতা কত জায়গায় দৌড়েছি আন্দোলনের জন্য!” চন্দনার সংযোজন, “যারা রাজনীতি করার, করে যাচ্ছে! মরছি আমরা!”
রাজনীতি অবশ্য থেমে থাকার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। সিঙ্গুর-কাঁটায় মুখ্যমন্ত্রীকে বিঁধে বিজেপি-র রাজ্য নেতা তথাগত রায় যেমন এ দিনই বলেছেন, “সিঙ্গুরের চাষিরা এখন মমতাকে বলছেন, আপনার কথাতেই সে সময় জমি দিতে চাইনি। এখন বলছি, জমি ফেরত চাই না। টাকা দিয়ে দিন।” এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু দাবি করেছেন, আইনি পথে গেলে জটিলতাই বাড়বে। তার চেয়ে অধিগৃহীত জমি চাষিদের দখল করতে দিলে বোঝা যাবে সরকার কত আন্তরিক!
এত জটিলতার চেয়ে যদি আবার কারখানা গড়তে ফিরিয়ে আনা যেত টাটাদের? অন্ধকারে নীরব থাকেন অনিচ্ছুক পরিবারের দুই বধূ।
নীরবতাই কি ঝড়ের লক্ষণ?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.