|
|
|
|
আসরে বিরোধীরাও |
শোভনদেব-ক্ষত সামালের চেষ্টা, তবু অস্বস্তি দলে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ প্রশমনের প্রক্রিয়া শুরু হল তৃণমূলে। আসরে নামলেন দুই মন্ত্রী। তবে দলীয় স্তরে শোভনদেববাবুর উপরে হামলার বিহিত না-হওয়া পর্যন্ত সমস্যা মেটার সম্ভাবনা কম।
বিধানসভার মুখ্য সরকারি সচেতক শোভনদেববাবুকে বৃহস্পতিবার ফোন করেন মমতা-ঘনিষ্ঠ, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পরে তাঁকে ফোন করে বিকালে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরে চা খেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান বিভাগীয় মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে শোভনদেববাবু আলোচনায় বসেছিলেন ঠিকই। তবে সহজে যে চিঁড়ে ভিজবে না, তা এ দিন বর্ষীয়ান বিধায়কের কথাতেই ধরা পড়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে ভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, তার বিশদ বিবরণ মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত ভাবে জানানোর কথা ভাবছেন শোভনদেববাবু। দলের তরফে ঘটনাটি নিয়ে নিজের বক্তব্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবেন সুব্রতবাবুও। প্রসঙ্গত, শোভনদেববাবুর উপরে হামলার ঘটনায় অসন্তুষ্ট মমতা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বুধবার রাতে দলের শ্রমিক সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রতবাবুকে ভার দেন। তার পরেই এ দিন ফোন করে সুব্রতবাবু ডাকেন শোভনদেববাবুকে। |
|
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামীদের বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার কলকাতা পুরসভায়। ছবি: রাজীব বসু |
সুব্রত-ফিরহাদের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা চললেও শোভনদেববাবুর হেনস্থার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার দুপুরে ধর্মতলা থেকে ওয়েলিংটন পর্যন্ত ধিক্কার মিছিল বেরোবে। শোভনদেববাবুর ঘনিষ্ঠ শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরাই এই মিছিলের আয়োজক। তবে মিছিলে সংগঠনের কোনও পতাকা বা ব্যানার থাকবে না বলে সংগঠন সূত্রের খবর। ফলে, তৃণমূলের অস্বস্তি এখনই কাটছে না। শোভনদেববাবুর নিগ্রহের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে আজ ধর্মতলায় প্রতিবাদ-সভা করার কথা ‘ক্যালক্যাটা মিউনিসিপ্যাল এমপ্লয়িজ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে’র। ওই সংগঠনের সদস্যেরা এ দিন পুরসভা থেকে একটি মৌনী মিছিল বার করেন। পুরসভায় প্রায় দেড় হাজার কর্মী ওই মিছিলে যোগ দেন। সংগঠনের নেতা প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের কাছে মায়ের মতো। আর শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় আত্মা। আত্মা যখন আহত, তখন তা দলের কাছে খুব বিপজ্জনক সময় বয়ে আনছে! অনেক নকশাল আর সিপিএম কর্মীরা তৃণমূলে ঢুকে পড়েছে। তাদের অবিলম্বে দল থেকে তাড়াতে হবে। শুক্রবারের সভায় আমরা সেই দাবি তুলব।” যদিও শোভনদেববাবু নিজে ওই সভায় থাকবেন না বলেই জানিয়েছেন।
তবে তৃণমূলের অন্দরের দুর্নীতি এবং অন্যায় নিয়ে জেহাদ অব্যাহত রেখেছেন শোভনদেববাবু। দলে সিন্ডিকেট চলার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে এ দিন তিনি ফের বলেছেন, “আমি নতুন করে আর কী বলব! শুধু সিপিএম থেকে আসা লোকেরাই দলে সিন্ডিকেট বানাচ্ছে, তা তো হয় না! আমি বলছি, দলের কেউ না থাকলে কী করে সিন্ডিকেট চলে! সর্বোচ্চ নেত্রীই তো দলে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি তো শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে। ফলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক, তা তিনি চান না।”
সুব্রতবাবুর সঙ্গে বৈঠক বা ফিরহাদের ফোন নিয়ে প্রকাশ্যে বিশেষ কিছু অবশ্য বলতে চাননি শোভনদেববাবু। সুব্রতবাবু ব্যক্তিগত ভাবে চা খেতে ডেকেছিলেন বলে জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, “আমিই বরং বলেছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা আমার কল্পনাতীত! মানসিক ভাবে আমি আহত হয়েছি। সুব্রত আমাকে সমবেদনা জানিয়েছে। বলেছে, এই ঘটনা অনভিপ্রেত।” বৈঠক শেষে সুব্রতবাবুও শোভনদেববাবুর উপরে হামলাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তাঁর আশা, “মুখ্যমন্ত্রীর উপরে শোভনদেবের আস্থা রয়েছে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীও নিশ্চয়ই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। কয়েক দিনের মধ্যে দলগত ভাবেই সমস্যাটা মিটে যাবে বলে আশা করছি।” তবে দলের সমর্থকদের একাংশের হাতেই শোভনদেববাবু নিগৃহীত হয়েছেন কি না, তা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য না-করে সুব্রতবাবু বলেন, “তাঁরা কোন দলের লোক, জানি না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। গোটা ব্যাপারটাই মুখ্যমন্ত্রীকে জানাব।”
তৃণমূলের অন্দরের এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ফায়দা নিতে প্রত্যাশিত ভাবেই সক্রিয় হয়েছে বিরোধীরা। তৃণমূলের দুই বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং শোভনদেববাবুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা সূযর্কান্ত মিশ্র এ দিন হাওড়ায় এক দলীয় জনসভায় বলেছেন, “তৃণমূলের নেতাদের উদ্দেশে বলছি, যাঁরা মানসম্মান নিয়ে থাকতে চান, তাঁরা দল ছেড়ে দিন! না হলে আপনাদের রবীন্দ্রনাথবাবুর মতো অবস্থা হবে।” রাসবিহারীর বিধায়কের হেনস্থার প্রসঙ্গ এনে সূর্যবাবুর আরও বক্তব্য, “শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এক সময়ে তৃণমূলের একমাত্র বিধায়ক ছিলেন। তাঁকে ঘুষি মারা হচ্ছে! এবং তৃণমূলের লোকেরাই তাঁকে ঘুষি মারছে। এমন কোনও দিন নেই, যে দিন তৃণমূলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষ হচ্ছে না!”
শোভনদেববাবুর সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে একমত না-হলেও তৃণমূলের কর্মীদের হাতে তাঁর আক্রান্ত হওয়া নিন্দনীয় বলেই সূর্যবাবু মন্তব্য করেছেন। পরে আলিমুদ্দিনে এ দিনই তিনি বলেছেন, “আমরা আগে বলেছিলাম শুধু বামপন্থীরাই নয়, সবাই তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হবেন। প্রথমে তৃণমূল কর্মীরা তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। আর এখন মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার সদস্য বা দলে তাঁর সহকর্মীরাও তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন! এত দিন তৃণমূলের নিচু তলায় এ কাজ শুরু হয়েছিল। এখন উপর তলাতেও হচ্ছে।”
গোটা ঘটনায় দলকে যে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে, তা প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন সুব্রতবাবুও। তাঁর বক্তব্য, “শৃঙ্খলার নিগড়ে আবদ্ধ নয়, এমন দলে এই ধরনের ঘটনা নতুন নয়। দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় এক সময় নির্বাচন করতে পারিনি আমরা। এমন হয়। মীমাংসাও করে নিতে হয়।”
হেনস্থায় ক্ষুণ্ণ ও মানসিক ভাবে আহত শোভনদেববাবু এ দিনও ফের বলেছেন, “দলটা করি মানুষের সেবা করার জন্য। পদ ও মন্ত্রিত্বের জন্য কারও কাছে কোনও দিন কিছু বলিনি। দল ভাঙিয়ে বাণিজ্য করি না! দলে সম্মান নিয়ে চলতে চাই। সেই সম্মান যদি সত্যি না-থাকে, তা হলে আমাকেও বিকল্প ভাবতে হবে বৈকি!” তাঁর দাবি, “কয়েক মাস আগে মহাকরণে মমতার সামনে বৈঠকের উল্লেখ করে সুব্রতও বলল, আমার (শোভনদেব) সামনেই তো কথা হল, যেখানে শোভনদেবের ইউনিয়ন আছে, সেখানে শোভনদেবই কাজ করবে। তা হলে আজ বিরোধ
হচ্ছে কেন?”
বিধানসভায় স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এ দিন দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয় শোভনদেববাবুর। তাঁরা দু’জনেই জানান, বিধানসভার আসন্ন অধিবেশন নিয়েই কথা হয়েছে। শোভনদেববাবুর বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, “ওই ঘটনা নিয়ে আমাকে সরকারি ভাবে কেউ জানাননি। সরকারি ভাবে জানালে আমার যা করণীয়, করব।” প্রসঙ্গত, ৭ ডিসেম্বর থেকে বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে। ঘটনার দু’দিন পরেও সরকারি মুখ্য সচেতকের উপরে হামলাকারীদের কেউ গ্রেফতার না-হওয়ায় মুখ খুলেছেন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। তাঁর বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। তাঁকে জানানোর পরেও শোভনদেববাবুর উপরে হামলাকারীর এক জনও গ্রেফতার না-হওয়ায় বিধায়ক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষের তা হলে কী অবস্থা!” |
|
|
|
|
|