|
|
|
|
বাজারি ঋণে নিয়ন্ত্রণ |
দেনাদারিতে দেওয়াল দিল্লির, রাজ্য ফাঁপরে |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
টানাটানির সংসারে ঋণের অর্থই পরিত্রাতা। সেই ‘সঞ্জীবনী’র উৎসে কেন্দ্রীয় সরকার কড়াকড়ি আরোপ করতেই রাজ্য পড়ে গিয়েছে ফাঁপরে।
বেতন-পেনশন আর রোজের খরচ মেটাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চলতি মাসে বাজার থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চেয়েছিল। সেই মর্মে মহাকরণের দাখিল করা আবেদন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক ফিরিয়ে দিয়েছে। মঞ্জুর হয়েছে দু’হাজার কোটির আর্জি। উপরন্তু ডিসেম্বরের জন্য দু’হাজার কোটি টাকা ঋণ তোলার যে আবেদন রাজ্য জানিয়ে রেখেছে, পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে তা হাতে পাওয়ার আশাও নেই। কারণ, এ জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি চিদম্বরমের অর্থ মন্ত্রক এখনও দেয়নি।
এতেই ঘোর চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন মহাকরণের কর্তারা।
তাঁরা বলছেন, সরকারের দৈনন্দিন খরচ চালাতে মূল ভরসা যে ঋণ, তার জোগানেও দিল্লি এ ভাবে লাগাম পরাতে চাইলে সমস্যা আরও তীব্র হবে। ওঁদের একাংশের মতে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল ইউপিএ সরকারে থাকাকালীন বাজারি ঋণ পেতে রাজ্যের তেমন অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তৃণমূল ইউপিএ ছাড়তেই কেন্দ্রের মতিগতি যেন অনেকটা বদলে গিয়েছে।
পর পর দু’মাস নিজেদের প্রয়োজনমতো ঋণ তুলতে চেয়েও অনুমোদন না-মেলার মধ্যে পরিবর্তিত রাজনৈতিক সমীকরণেরই ছায়া দেখছেন রাজ্য প্রশাসনের এই মহল। তাঁদের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি বহাল থাকলে জানুয়ারিতে অর্থসঙ্কটে রাজ্য কোষাগারে নাভিশ্বাস উঠবে।
কেন্দ্রের যুক্তি অবশ্য ভিন্ন। দিল্লির ব্যাখ্যা: চলতি অর্থবর্ষের প্রথম আট মাসে (নভেম্বর ধরে) প্রাপ্য ঋণের দুই-তৃতীয়াংশই রাজ্য তুলে নিয়েছে। উল্লেখ্য, বাজেট নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু হওয়ার পরে কোনও রাজ্য যত খুশি দেনা করতে পারে না। নির্দিষ্ট কোটা থেকে মাসিক ভারসাম্য বজায় রেখে ঋণ তুলতে হয়। কেন্দ্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সেই ‘ভারসাম্য’ রাখতে পারেনি। তাই অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে ঋণের অভাবে রাজ্যকে যাতে নাস্তানাবুদ হতে না-হয়, সেই লক্ষ্যেই নভেম্বরের অঙ্ক ছাঁটাই করা হয়েছে। এ বছরে বাজার থেকে কত দেনা করেছে পশ্চিমবঙ্গ?
অর্থ দফতর সূত্রের খবর: চলতি অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের ঋণ-কোটা মোট ২২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিলামে বন্ড বেচে এই আট মাসে ন’কিস্তিতে তার ১৪ হাজার কোটি-ই রাজ্য তুলে নিয়েছে। বাজার থেকে আর তোলা যাবে সাকুল্যে চার হাজার কোটি। এ ছাড়া স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নে আরআইডিএফ তহবিল থেকে নেওয়ার কথা ৮০০ কোটি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি), কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প (কেইআইপি-২)-সহ অন্য কয়েকটি ক্ষেত্র থেকেও ঋণ পাওয়ার আশা রয়েছে। অর্থ দফতরের এক মুখপাত্র জানান, প্রকল্প-ভিত্তিক ঋণের টাকায় বেতন-পেনশন দেওয়া যায় না। তাই রোজের খরচ মেটাতে বন্ড বিক্রির টাকাই দফতরের মূল ভরসা।
কিন্তু বাজারি ঋণ সংগ্রহে ভারসাম্য রাখা যাচ্ছে না কেন?
অর্থ-কর্তাদের ব্যাখ্যা: বছরশুরুতে হিসেব ছিল, স্বল্প সঞ্চয় থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ মিলবে। অথচ বিভিন্ন চিট ফান্ডে আমানতের হিড়িকে ডাকঘরে জমার চেয়ে টাকা তোলা হয়েছে বেশি। যে কারণে প্রথম আট মাস স্বল্প সঞ্চয় থেকে কানাকড়িও ঋণ মেলেনি। তার উপরে পরিকল্পনা-বহির্ভূত ব্যয় সীমা ছাড়ানোয় ভাঁড়ারে ত্রাহি রব উঠেছে। সেই সঙ্কট সামাল দিতে গিয়েই প্রথম আট মাসে বেশি দেনা হয়ে গিয়েছে বলে অর্থ-কর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন।
এ দিকে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে রাজ্যের নিজস্ব আয় কিন্তু অনেকটা বেড়েছে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের দাবি: গত অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসের তুলনায় এ বারে রাজস্ব আদায় প্রায় ৩৬% বেড়েছে। এই ধারা বজায় থাকলে বার্ষিক আদায় ৩১ হাজার কোটির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে তাঁর আশা। অর্থমন্ত্রী একাধিক বার এই বলে আক্ষেপ করেছেন যে, বাম জমানার চাপিয়ে দেওয়া বোঝা টানতেই তাঁর অবস্থা সঙ্গিন। বছরে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের সুদ-আসল শোধ করতে গিয়েই কোষাগারে হাঁড়ির হাল হচ্ছে বলে তাঁর দাবি। অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, আর্থিক দুর্দশার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ রাজ্যের বন্ড কিনতেই সুদ চায় সবচেয়ে বেশি। তবে রাজ্য এ পর্যন্ত কোনও দিন বাজারি ঋণ শুধতে ব্যর্থ হয়নি।
কিন্তু এ বার সেই বাজারি ঋণের জোগানেও টান পড়ায় প্রমাদ গুনছেন মহাকরণের কর্তারা। |
|
|
|
|
|