|
|
|
|
অসহিষ্ণু হলে টিকবেন না ক্ষমতায়: কাটজু |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
নিজেকে না-বদলালে তাঁর পক্ষে বেশি দিন মুখ্যমন্ত্রী থাকা সম্ভব হবে না বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সতর্ক করে দিলেন প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু। বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রীকে ই-মেল মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে কাটজু বলেছেন, প্রশাসনে তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছেন। মন্ত্রী-আমলারাও তাঁর সঙ্গে নির্ভয়ে কথা বলতে পারেন না। মুখ্যমন্ত্রীর অনিশ্চিত ও খামখেয়ালি আচরণে সবাই তটস্থ। কাটজুর আশঙ্কা, অসহিষ্ণুতা এবং খামখেয়ালিপনা মমতাকে বড় বিপদে ফেলতে পারে। এ দিনই আবার এবিপি আনন্দের সঙ্গে টেলিফোন কথোপকথনে তিনি বলেছেন, “মমতার অহং বোধ বেশি। উনি রাজনীতির যোগ্য নন।”
তথ্যসচিব নন্দিনী চক্রবর্তীর মাধ্যমে তাঁকে পাঠানো কাটজুর চিঠি এ দিন বিকেল পর্যন্ত পাননি বলে দাবি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও চিঠির বিষয়বস্তু সামনে এসে যাওয়ার পরে (নিজের ব্লগে চিঠিটি প্রকাশ করে দিয়েছেন কাটজু নিজেই) রাজ্য জুড়ে আলোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই কাটজুর তোলা অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। কিন্তু নাগরিক সমাজের অনেকেরই বক্তব্য, এই কথাগুলো তাঁরা বহু দিন ধরেই বলতে চাইছিলেন। পরিবেশ, পরিস্থিতির কারণে বলে উঠতে পারছিলেন না। কাটজু তাঁদের উপলব্ধিকেই ভাষা জুগিয়েছেন।
একদা মমতার ভূয়সী প্রশংসা করা কাটজু রবিবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে তাঁকে অসহিষ্ণু বলে বিঁধেছিলেন। বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। স্তাবক (ইয়েসম্যান) পছন্দ করেন।” বৃহস্পতিবার আরও কড়া ভাষায় যে ই-মেল তিনি পাঠিয়েছেন তার মূল উদ্দেশ্য, সম্প্রতি ফেসবুকে মন্তব্য লেখা দুই তরুণীর গ্রেফতার নিয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের ভূমিকা মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কাটজু লিখেছেন, “সম্প্রতি বালাসাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পর মুম্বই স্তব্ধ হওয়ায় এক তরুণী ফেসবুকে তাঁর আপত্তির কথা জানান। তার জেরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সেই ঘটনায় জড়িত পুলিশ অফিসারদের সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন।” |
|
মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলনে। —নিজস্ব চিত্র |
কাটজু মমতাকে আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন অম্বিকেশ মহাপাত্রের কথা। মুখ্যমন্ত্রীকে কাটজু বলেছেন, “আমার অনুরোধ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহাপাত্র এবং (বেলপাহাড়ির সভায়) শিলাদিত্য চৌধুরীকে গ্রেফতারের ঘটনায় জড়িত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধেও আপনি একই ব্যবস্থা নিন। আপনার উচিত অবিলম্বে ওই দু’জনের বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলা তুলে নেওয়া এবং ওঁদের কাছে ক্ষমা চাওয়া।” পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি হওয়া আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনের প্রসঙ্গও তুলেছেন কাটজু। লিখেছেন, “আপনার উচিত, দময়ন্তী সেনের মতো নির্ভীক পুলিশ অফিসারকে ফিরিয়ে আনা। তাঁকেও আপনি অন্যায় ভাবে পরিস্থিতির শিকার বানিয়েছেন। তার জন্য তাঁর কাছে আপনার প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত।”
কয়েক মাস আগে একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে মাওবাদী আখ্যা দিয়ে অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মমতা। সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে কাটজু লিখেছেন, “আপনি তানিয়া ভরদ্বাজকে অপমান করেছিলেন। তাঁর কাছেও আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।”
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কাটজুর পরামর্শ, “আমরা সবাই মানুষ এবং আমাদের সবারই ভুলভ্রান্তি হয়। কিন্তু নিজেদের ভুল বুঝতে পারা এবং তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়াটাই ভদ্রতার পরিচয়। আমি জোরের সঙ্গে বলছি, আপনি যদি এটা করতে পারেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশের মানুষের কাছে আপনি অনেক উঁচু আসন পাবেন।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সরাসরি কাটজুর পরামর্শ, অনুরোধ কিংবা সতর্কবার্তার কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। কাটজুর কাছ থেকে কোনও চিঠি পাননি বলে মন্তব্য করে মহাকরণে মমতা বলেন, “এই সরকার কারও কথায় চলবে না। কারও নিয়ন্ত্রণে চলবে না। এই সরকারকে গায়ের জোরে-চমকে-ধমকে-ব্ল্যাকমেলিং করে কিছু করা যাবে না। এই সরকার জনগণের সঙ্গে ছিল, আছে, থাকবে। এই সরকার কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করে না। সংবিধান মেনে চলে। আমরা তো কত সময় সহকর্মীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছি। আর কোনও সরকার এ রকম করেছে বলে আমার জানা নেই। এই সরকার মানবিক। পাশবিক, দানবিক নয়।”
কাটজু কিন্তু মমতার দাবি উড়িয়ে পরে এবিপি আনন্দকে বলেছেন, মানুষ এই সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। শিল্প হচ্ছে না। তিনি শুনেছেন যে, চিট ফান্ডগুলি সরকার চালাচ্ছে। এমনকী ত্রিফলা বাতি নিয়ে দুর্নীতির কথাও তাঁর কানে এসেছে।
কাটজু মমতাকে লিখেছেন, “আমি কলকাতায় যাতায়াত করে জেনেছি, রাজ্যের মন্ত্রী-আমলারা আপনার সামনে নির্ভয়ে নিজেদের মনের কথা বলতে পারেন না। আপনার অনিশ্চিত এবং খামখেয়ালি আচরণে তটস্থ থাকেন।... নিজেকে না বদলালে, সহনশীল না হলে আপনি কিন্তু বেশি দিন মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।” পরে তিনি বলেন, “অসহিষ্ণু শাসককে সহ্য করা যায় না। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও না।”
কিন্তু সরকারের অন্দরের কথা কাটজু জানলেন কী ভাবে? এবিপি আনন্দের সঙ্গে টেলিফোন প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, “কলকাতায় বার বার গিয়েছি। অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। তাঁদের নাম আমি প্রকাশ করতে চাই না। তবে তাঁদের সঙ্গে কথার সূত্রেই আমার এই ধারণা হয়েছে।”
আমলারা নির্ভয়ে কথা বলতে না পারলে প্রশাসনের সামনে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়, তার ব্যাখ্যা দিয়ে কাটজু মমতাকে লিখেছেন, “কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, দক্ষ শাসক তিনিই, যিনি ভাল উপদেষ্টা নিয়োগ করেন এবং তাঁদের পরামর্শ মানেন।... এই প্রসঙ্গে দেশের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেলের কথা বলি। তিনি তাঁর সচিবদের নির্ভয়ে মতামত দিতে বলতেন। এমনকী সেই মতামত পটেলের নিজের মতের সম্পূর্ণ বিরোধী হলেও তিনি কখনও তা নিয়ে কিছু মনে করতেন না। বরং পটেলের বক্তব্য ছিল, আমলারা খোলাখুলি কথা না বললে তাঁদের কোনও কার্যকারিতা নেই।”
কাটজুর এই অভিযোগ কিন্তু মানতে চাননি রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তাঁর তির্যক উক্তি, “উনি (কাটজু) কি মহাকরণের কাকতাড়ুয়া? সব সময় মহাকরণের সামনে পাহারা দেন? আর যদি থাকেন, তা হলে কি দেখেন না যে, আমরা কত ঘনঘন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে যাই? আমরা ভীত তো নই-ই, বরং এমন এক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে পেরে অভিভূত।” এখানেই না-থেমে সুব্রতবাবু বলেছেন, “কাটজু এক বার মমতার প্রশংসা করেন, আর এক বার নিন্দা করেন। ওঁর আচরণে মনে হয়, মানসিক রোগের চিকিৎসক দেখানো দরকার।” আর কী বলছেন আমলারা?
রাজ্যের বিদ্যুৎসচিব তথা রাজ্য আইএএস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মলয় দে জানিয়েছেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য তিনি করবেন না। কারণ কাটজু কী লিখেছেন, তা তাঁর অজানা।
তানিয়া ভরদ্বাজও এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কেবল বলেছেন, “ঘটনাটা আমি ভুলে যেতে চাই।”
অম্বিকেশ মহাপাত্র অবশ্য মনে করেন, কাটজু যা বলেছেন, তা বাংলার বহু মানুষেরই মনের কথা। তিনি বলেন, “এই সরকার কোনও সুপারিশ মানে না। মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলেও শোনে না। একটি সর্বভারতীয় ক্ষেত্র থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। আমার মনে হয়, সরকারের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এবং ভুল স্বীকার করা উচিত।”
বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় গ্রেফতার হওয়া শিলাদিত্য চৌধুরী এ দিনও আক্ষেপ করে বলেছেন, “বিনা কারণে তকমা এঁটে দেওয়া হয়েছে। জেল খেটেছি। ওঁর (কাটজু) নাম শুনেছি। বড় মাপের মানুষ। উনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমার সঙ্গে অন্যায় হয়েছিল।”
তোলাবাজির অভিযোগ থেকে শুরু করে দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিদ্রোহ নিয়ে মমতা যখন জেরবার তখন কাটজুর চিঠি বিরোধীদের হাতে নয়া অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “আমি মনে করি, কাটজু তাঁর চিঠির মাধ্যমে বন্ধুর মতো মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা অপরাধ জগতের ভাষা। সংবাদমাধ্যম, বিরোধী দল সবার ব্যাপারেই উনি একই রকম অসহিষ্ণু মনোভাব দেখাচ্ছেন। এর বিরোধিতা করছি।”
সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য বৃন্দা কারাটও বলেছেন, “কাটজু নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। এর আগে ফেসবুক বিতর্কের জেরে কংগ্রেস-এনসিপি সরকার দুই ছাত্রীকে গ্রেফতার করার পর তিনি বিরোধিতা, নিন্দা করে ওই সরকারকেও চিঠি দিয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে যা পরামর্শ দিয়েছেন তা-ও সঠিক।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করছে এক দূষিত রাজনীতি। মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমলাদেরও কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।”
|
আমি কোনও চিঠি পাইনি। এই সরকার
কারও
কথায় চলবে না। এই সরকারকে গায়ের
জোরে-চমকে-ধমকে-ব্ল্যাকমেলিং করে কিছু করা
যাবে না। এই সরকার মানবিক। পাশবিক-দানবিক নয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মুখ্যমন্ত্রী |
উনি (কাটজু) কি মহাকরণের
কাকতাড়ুয়া? আমরা ভীত তো
নই-ই, এমন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে
কাজ করতে পেরে অভিভূত।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়
পঞ্চায়েত মন্ত্রী |
উনি বাংলার মানুষের
মনের
কথাই বলেছেন।
অম্বিকেশ মহাপাত্র
অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় |
উনি বড় মাপের মানুষ। উনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন,
আমার সঙ্গে অন্যায়
করা হয়েছিল।
শিলাদিত্য চৌধুরী
বিনপুর |
|
|
|
|
|
|