সুব্রত ভট্টাচার্য লিখেছেন, আপনি মোহনবাগানকে আরও ডোবাবেন!
পুণের হোটেলে পা দেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই কথাটা শুনে সামান্যতম অস্বস্তিতেও পড়লেন না করিম বেঞ্চারিফা। “ও সব কথার কোনও গুরুত্ব নেই আমার কাছে। আমি কলকাতার নাড়ি জানি। আগেও এ রকম কথা শুনেছি কিছু প্রাক্তনের মুখে। তার পরও মোহনবাগান ফেড কাপ, কলকাতা লিগ জিতেছে। যে যা ইচ্ছে বলুক। আমি এখন নিজের এ সব কথা-টথার থেকে টিমের চোট-আঘাত নিয়েই বেশি ভাবছি।” সুব্রতর নাম মুখে না এনে বলে দেন মোহনবাগান কোচ। বরং সবুজ-মেরুনের ঘরের ছেলেকে কটাক্ষ করে মরক্কান কোচের প্রতিক্রিয়া, “কোনও প্রাক্তনের সমালোচনার জবাব আমি দেব না। আমি দায়বদ্ধ মোহনবাগানের প্রকৃত সমর্থকদের কাছে। তারা আমাকে জানে। আমার কোচিংয়ে ভরসা রাখে।”
ডেম্পো ম্যাচে হারের জেরে এক দিকে মোহন-কোচকে সুব্রতর চাঁচাছোলা আক্রমণ, অন্য দিকে চোট-আঘাতে জর্জরিত ইচে-নবি-জুয়েলদের নিয়ে সমস্যা। ঘরে-বাইরে বিপদ ঘাড়ে নিয়ে গোয়া থেকে আজ বিকেলে মোহনবাগান যখন পুণে পৌঁছল, আচমকা টিমের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করলেন ফুটবল বিভাগের প্রধান, ক্লাবের অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত। সচিব অঞ্জন মিত্রকে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “মোহনবাগান গত এক দশকে তিনটে আই লিগ, ফেড কাপ-সহ বহু ট্রফি জিতেছে। প্রতিবারই টিম তৈরি করায় আমার ভূমিকা ছিল। পনেরো বছর ধরে টিম করছি। এ বার টিম এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ। এত সমালোচনা হচ্ছে। আমি সমস্ত দায়ভার নিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছি।” সন্ধেয় এই খবর পুণের হোটেলে পৌঁছনোর পর ফুটবলারদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া। ওডাফা বলে দিলেন, “এ সব কী হচ্ছে আমাদের ক্লাবে? আই লিগ চ্যাম্পিয়নের দৌড় থেকে তো আমরা একেবারে ছিটকে যাইনি। সবে তো লিগ শুরু।”
সুব্রত ভট্টাচার্য আপনার নাম করে আক্রমণ করেছেন বলে কি দ্রুত সরে দাঁড়ালেন? দেবাশিস মানতে চান না। “সদস্য-সমর্থকদের কাছে আমি দায়বদ্ধ। সে জন্য সরে দাঁড়ালাম। বাবলুদাকে সম্মান করি। উনি যখনই আমাদের দলের কোচ থাকেন না, ক্লাবের বিরুদ্ধে উল্টোপাল্টা বলেন। বাবলুদার কোচিংয়ে মোহনবাগান যে দুটো আই লিগ বা ফেড কাপ পেয়েছে প্রতিবারই টিম কিন্তু আমারই তৈরি করে দেওয়া। সেটা মনে হয় উনি ভুলে গিয়েছেন।” অর্থসচিবের পদত্যাগপত্র রাত পর্যন্ত গ্রহণ করেননি মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র। ফোনে যোগাযোগ করা হলে বলেন, “দলের ব্যর্থতার দায় দেবাশিসের একার নয়। আমাদের সকলের। ওকে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। বাকিটা কাল বলব।”
দু’দিন পরেই ডেরেক পেরিরার পুণে এফসি-র বিরুদ্ধে ম্যাচ। তার পর কলকাতায় ফিরে ৯ ডিসেম্বর টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত মর্গ্যানের ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ডার্বি। মহাগুরুত্বপূর্ণ সময় কোনও রকম ডামাডোলের প্রভাব টিমের উপর পড়তে দিতে চাইছেন না করিম। তাঁর মরিয়া লক্ষ্য, রবিবার পুণের ম্যাচ থেকে পুরো পয়েন্ট তুলে নিয়ে ডার্বির আগে টিমকে চাঙ্গা করে তুলতে। “আমার একমাত্র কাজ টিমকে জয়ের রাস্তায় এনে তোলা। পুণে থেকেই যাতে সেটা শুরু হয় তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি।”
কোচ বললেও ডেম্পোর কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই মোহনবাগানের পক্ষে কি আদৌ উঠে দাঁড়ানো সম্ভব? বিশেষ করে ফুটবলারদের মনোবল যে ভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে। পুণে আসার বিমানে এবং পৌঁছে প্রশ্নটি রাখা হয়েছিল সবুজ-মেরুনের চার সিনিয়র ফুটবলারের কাছে।
ওডাফা: চোট-আঘাত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেই আমরা উঠে দাঁড়াব। তখন কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না। আর সেটা আজ না হোক কাল হবেই।
নবি: এই দলের প্রধান সমস্যা, সবার মধ্যে জেতার একশোভাগ তাগিদ নেই। খেলছি বলে খেলা আর জেতার জন্য খেলা দু’টো কিন্তু আলাদা। সালগাওকরকে তিন গোল দিলাম আর ডেম্পোর কাছে তিন গোলে হারলাম, এত পার্থক্য সাত দিনের মধ্যে হয় কী ভাবে?
শিল্টন: আমাদের ভাগ্য খুব খারাপ যাচ্ছে। ডেম্পো ম্যাচ আমরা দারুণ শুরু করেছিলাম। তিনটে সহজ সুযোগ নষ্ট হল। একটা গোল হলেই দেখতেন খেলা অন্য রকম হয়ে যেত। তবে লিগের দৌড় থেকে আমরা কিন্তু ছিটকে যাইনি।
মাসি: অ্যাওয়ে ম্যাচ সব সময় কঠিন। কিন্তু জেতা ম্যাচগুলো আমরা সামান্য ভুলে ড্র করছি বা হারছি। তবে সবাই ফিট হয়ে উঠলে সমস্যা হবে না।
ডেম্পো ম্যাচে বিপর্যয়ের পর পুরো টিমকে নিয়ে গোয়ার রিসর্টেই গত রাতে মিটিং করেন করিম। পুণের হোটেলেও বিকেল থেকে রাত ফুটবলারদের নিজের ঘরে ডেকে-ডেকে মিটিং করলেন তিনি। “সালগাওকরে যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন এখনকার মোহনবাগানের চেয়েও ওদের খারাপ কন্ডিশন ছিল। সালগাওকরকে আই লিগ, ফেড কাপ জিতিয়েছিলাম। মোহনবাগানেও আমি এখনও আই লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছি,” দাবি করলেন করিম।
করিমের টিমের পক্ষে একটা সুখবর, পুণে এফসি-র বিরুদ্ধে নবি খুব সম্ভবত দলে ফিরছেন। নিজেই বললেন, “ব্যথা অনেক কম। মনে হয় খেলতে পারব।” তবে ইচের খেলার সম্ভাবনা নেই। খোঁড়ালেও নির্মল-ডেনসন, দু’জনই রবিবার খেলবেন মোগাদের বিরুদ্ধে। করিম ব্যাখা দিলেন, “টোলগেকে ধরে আমাদের প্রথম টিমের অর্ধেক ফুটবলারই নেই। তার ওপর যে কোনও নতুন কোচ আসার পর একটা পর্ব চলে। কোচকে টিম বুঝতে হয়। ফুটবলাররা কোচকে বোঝার চেষ্টা করে। সেই সময়ই পরপর বাইরের ম্যাচ পড়েছে। সমস্যা হচ্ছে। তবে আমি আশাবাদী এ সব বেশি দিন স্থায়ী হবে না। আমি ম্যাজিশিয়ান নই। একটু সময় দিতে হবে।”
শুধু ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্যই নন, ডেম্পো ম্যাচের পর ফেসবুক-টুইটারে উপচে পড়ছে মোহনবাগান সদস্য-সমর্থকদের ক্ষোভ। ল্যাপটপ-আইপ্যাড নিয়ে ঘোরা করিম যে সে সব দেখেননি তা নিশ্চয়ই নয়। তাঁর ফুটবলাররাও অনেকে দেখছেন। করিম চোয়াল শক্ত করে পাল্টা লড়াইয়ে নামার পথে বলছেন, “এ বার মোহনবাগানের দায়িত্ব নেওয়ার দিনই বলেছিলাম, আমার বিচার করবেন দ্বিতীয় বছরে। কিন্তু প্রথম বছরেও স্বপ্ন দেখা ছাড়ছি না। আশা করছি এ বারও সাফল্য পাব।”
করিমের কথাতেই স্পষ্ট, সব সমালোচনার জবাব মাঠেই দিতে চাইছেন তিনি। |