বুনোদের বনে রাখতে উদ্যোগ বনমন্ত্রীর |
হাতির বুদ্ধির কাছে হার মানতে হচ্ছে বন দফতরকে। বুনোরা এখন আর কোনও বাধাই মানতে না চাওয়ায় জঙ্গলে বৈদ্যুতিক তারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকেজো হতে বসেছে। এই ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলায় উদ্বিগ্ন বনকর্তারা। বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনও মনে করছেন, হাতিরা যে ভাবে বৈদ্যুতিক বেড়া বিচ্ছিন্ন করে লোকালয়ে ঢুকছে তাতে বিকল্প ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। বনমন্ত্রী বলেন, “বৈদ্যুতিক ফেন্সিং ব্যবস্থা সে ভাবে কাজ করছে না। হাতিরা পছন্দ করে না এমন চাষ-সহ জঙ্গলের ভিতরে তাদের আটকে রাখার জন্য তাদের প্রিয় ফল গাছ বেশি করে লাগানোয় জোর দেওয়ার কথা ভাবছি।”
জঙ্গল ছেড়ে বুনো হাতিরা বাইরে বেরিয়ে পড়ে ঘর বাড়ি, শস্য এবং প্রাণহানির মতো ঘটনা ঠেকাতে দুই দশক আগে জঙ্গলের পাশে ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক তারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গে মহানন্দায় প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ওই তারে নিয়মিত বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে হাতির হানা রোখা সম্ভব হয়। পরে বক্সা, জলদাপাড়া, গরুমারা-সহ প্রায় ২০০ কিমি এলাকায় বেড়া দেয় বন দফতর। ৪-৫ ভোল্টের ব্যাটারি-চালিত ওই ফেন্সিং জন্তুদের শারীরিক কোনও ক্ষতি করে না। তাদের গা তারে স্পর্শ করলে ঝাঁকুনিতে তারা তারের পাশে ঘেঁষত না। প্রথমে তা কার্যকর হলেও এখন কী করে বিনা আঘাতে বেড়া পেরোতে হয়, তা রপ্ত করে ফেলেছে হাতিরা।
বন দফতরের কয়েক জন কর্তা জানান, দুই দশক আগে সারা উত্তরবঙ্গে ২০০টির মতো হাতি দাপিয়ে বেড়াত। ২০১১ সালের হাতি শুমারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪৭টিতে। জঙ্গলের ভেতরে এত সংখ্যক হাতির পেট ভরাতে পাতা, ঘাস কিংবা গাছের ছাল থাকলেও ফলের গাছগুলি আজ বিলীন হতে বসেছে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ধান, গম খেতে হাতির দল হানা দিচ্ছে।
বনকর্মীরা জানিয়েছেন, হাতি জেনে গিয়েছে তাদের দাঁত বিদ্যুৎবাহী নয়। তাই তারা কোথাও দাঁত তার ছেঁড়ার কাজে ব্যবহার করছে। বেড়া দেওয়ার জন্য যে খুঁটি ব্যবহার করা হয় সেগুলিতেও বিদ্যুৎ থাকে না। সামনের পা দিয়ে খুঁটি ভেঙে গ্রামে ঢুকছে তারা। এমনকী তারের উপর পাশের গাছের বড় ডাল বা বাড়ন্ত গাছ ফেলে তার ডিঙিয়ে তারা ঢুকে পড়ছে। তবে দলে বাচ্চা হাতি থাকলে সে কাজ তারা খুবই সন্তর্পণে করে থাকে।
বক্সার এক বন অফিসার জানান, দল বেঁধে হাতিরা বেড়ার কাছে এলে প্রথমে দলপতি তারের কাছে যায়। বিদ্যুৎবাহী তারের কাছে শুঁড় নিয়ে গিয়ে তারা বুঝে ফেলে বিদ্যুৎ রয়েছে কি না। বিদ্যুৎ না থাকলে ফেন্সিং ভেঙে ফেলে। তবে দলে শাবক থাকলে গাছের ডাল ভেঙে, দাঁত দিয়ে তার ছিঁড়ে বা পা দিয়ে খুঁটি ভেঙে সাবধানে বেড়া পার হয়।
নেপালে হাতির হানা বন্ধ করতে ২০০৮ সালে পাঁচ কিমি এলাকায় বৈদ্যুতিক বেড়া দেওয়া হলেও এক বছর পর থেকেই তার ছিঁড়ে হাতির দল নেপালে ঢুকে পড়ছে। জলপাইগুড়ির ডিএফও সুমিতা ঘটকের কথায়, “দলছুট হাতি কিংবা যে সমস্ত রেসিডেন্সিয়াল হাতি আমাদের এ জঙ্গলে রয়েছে তারা অনায়াসে বেড়া ভেঙে ফেলে। তবে বাইরে থেকে আসা হাতি বা তাদের দলে বাচ্চা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেয় না।” বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা রবীন্দ্র কুমার সাইনি বলেন, “হাতির দল খুঁটি ভাঙলে বা তার ছিঁড়লে দ্রুত তা ঠিক করে দেওয়া হয়। কিছু হাতি মাঝেমধ্যে এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে।” হস্তিবিদ পার্বতী বড়ুয়ার কথায়, “হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। কী করে ওই বেড়া ভাঙা যায়, তা শিখতে তাদের বেশি সময় লাগে না। তা ছাড়া উত্তরবঙ্গে জঙ্গলের ঘনত্ব খুব কম হওয়ায় তারা নিয়মিত লোকালয়ে ঢুকে মানুষের স্পর্শ পাচ্ছে। তাই অন্য জঙ্গলের হাতিদের তুলনায় তাদের বুদ্ধি বেশি। বন দফতরের উচিত বিকল্প ব্যবস্থা করা।” বন দফতরের এক কর্তার কথায়, “হাতি চালাক হয়েছে বটে, তবে বন দফতর আগের তুলনায় উদাসীন। ব্যাটারি সচল রাখা-সহ বেড়া ভাঙলে তা দ্রুত মেরামতির জন্য তেমন ভাবে টাকা বরাদ্দ করছে না দফতর। গাছের ডাল পড়ে দুই তারের সংযোগ হলে অনেক সময় তা অচল হয়ে যায়, সে দিকে লক্ষ্য রাখার লোক নেই। হিতেনবাবু অবশ্য পর্যাপ্ত কর্মীর অভাবের বিষয় মেনে নিয়েছেন। তাঁর কথায়, “কর্মী অভাব দূর করা হলে অনেক সমস্যা মিটবে।” |