ক্লান্ত, হতাশ অনিচ্ছুক চাষিরা এ বার চাইছেন জমির দাম
র কোনও রাখঢাক রইল না। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরা এ বার অধিগৃহীত জমির দাম চেয়েই বসলেন। বাজেমিলিয়া, বেড়াবেড়ি, গোপালনগরের নানা পাড়ায় চাষিরা জানিয়ে দিলেন, “আন্দোলন ঢের হয়েছে। জমি ফেরত পাওয়ার আশা বিশ বাঁও জলে। এ বার জমির টাকাটা পেয়ে অন্তত খেয়ে-পরে বাঁচি।” বাম জমানায় টাটা মোটরসের ন্যানো গাড়ির প্রকল্পের জন্য অধিগৃহীত জমি তৃণমূল সরকার ফেরত দেবে, সে আশায় এই চাষিরা এত দিন জমির মূল্যের চেক নেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে বসার দেড় বছরের মাথায় সেই ভরসা হারালেন তাঁরা।
এক সময়ে এই বাসিন্দারাই জীবনের বাজি রেখে বামফ্রন্ট সরকার এবং সিপিএম-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এ দিন মহাকরণে মমতাও বলেছেন, সিঙ্গুরের মানুষকে সম্মান জানিয়েই তিনি সেখানে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। কিন্তু অনিচ্ছুক চাষিরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর-সফরে এলে তাঁর কাছে দরবার করতে চান। কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলে তাঁরা জানিয়ে দিতে চান, দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে আন্দোলন করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত। সংসারও চলছে না। এ বার জমির টাকাটা দিয়ে দিলেই ভাল।
মুখ্যমন্ত্রী আজ অবশ্য কোনও জনসভা করছেন না বলেই আপাতত ঠিক রয়েছে। শুধুমাত্র প্রশাসনিক বৈঠক সেরে ফিরবেন। বৃহস্পতিবার সে কথা নিজেই বলেছেন মহাকরণে। তবে কয়েকটি সরকারি প্রকল্পের সাহায্য সরাসরি তাঁর তুলে দেওয়ার কথা ছিল সিঙ্গুরের কয়েক জনের হাতে। হুগলি জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সিঙ্গুর বিডিও অফিসে সেই কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। দফতরে জায়গার সমস্যা থাকায় এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন কর্তারা। জেলাশাসক মনমীত নন্দা বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করব না।” তবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে গোলমালের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না জেলা পুলিশের একটি অংশ। তাদেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে বলা হয়েছে। ‘সংযত’ থাকারও নির্দেশ আছে। প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সিঙ্গুরের ভূমি আন্দোলনের অন্যতম নেতা রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, তিনি সকলকে সংযত থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।

সমাপ্তি ঘোষ

হেমন্ত ঘোষ

যুধিষ্ঠির ঘোষ

জিতেন ঘোষ
বুধবারই বিক্ষোভের আঁচ মালুম পেয়েছেন নব নির্বাচিত মন্ত্রী তথা সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বেচারাম মান্না। সিঙ্গুর ব্লক অফিসে চালের কুপন সংগ্রহের লাইনে দাঁড়ানো মানুষের প্রশ্ন সামলাতে গিয়ে নাকাল হন বেচারাম। গত চার মাস ধরে সরকারি সাহায্যের টাকা না পেয়ে অনিচ্ছুক চাষিরা তাঁকে দেখে ক্ষোভ উগরে দেন। আজ তাঁরা কথা বলতে চান মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। গোপালনগরের ঘোষপাড়ার অনিচ্ছুক চাষি পরিবারের বধূ সমাপ্তি ঘোষের কথায়, “আমরা শুরু থেকে আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। আর পারছি না। সুযোগ পেলে শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রীকে বলব, জমি ফেরত দিন। না হলে তিন গুণ টাকা দিন। আর কত দিন ভিখারির মতো লাইনে দাঁড়িয়ে চাল নেব? কী পদ্ধতিতে ওই টাকা পাব, খোঁজ-খবর করছি।”
মুখ্যমন্ত্রী যদিও বৃহস্পতিবার মহাকরণে বলেন, “সিঙ্গুরে কালকের ঘটনাটা কিছুই হয়নি। লাইনে চারশো জন দাঁড়ালে একশো জন একটু তাড়াতাড়ি নিতে চায়। তাই নিয়ে হুড়োহুড়ি হয়েছে।” তাঁর সংযোজন, অসুস্থ থাকায় কিছু দিন কাজ করতে পারেননি হুগলির আগের জেলাশাসক (শ্রীপ্রিয়া রঙ্গরাজন)। নতুন জেলাশাসক সবেমাত্র দায়িত্ব নেওয়ায় টাকা বিলিতে কিছুটা দেরি হয়েছে। সমস্যা দ্রুত মিটে যাবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি। কিন্তু তাতে সিঙ্গুরের দীর্ঘ দিনের ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি।
কথা হচ্ছিল মধ্যপাড়ার বাসিন্দা জিতেন ঘোষের সঙ্গে। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক এই চাষি ২০০৬ সাল থেকে তৃণমূলের নেতৃত্বে জমি আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। তাঁর দুই বিঘে জমি টাটাদের প্রকল্প এলাকায় অধিগৃহীত হয়েছিল। জমির টাকা নেননি জিতেনবাবু। কিন্তু এ বার তাঁর মনোবলে চিড় ধরেছে। বললেন, “বৃদ্ধ হয়েছি। আন্দোলন অনেক হল। আর পারছি না। সরকারি সাহায্যের টাকাটাও নিয়মিত পেলাম না। এ বার জমির টাকা দিলেই নিয়ে নেব।”
হেমন্ত ঘোষের চার বিঘে জমি অধিগৃহীত হয়। তিনি বলেন, “ছোট ছোট দু’টো ছেলে। দিনের পর দিন মুখ বুজে আন্দোলন করেছি। দিদির (মমতা) উপরে ভরসা রেখেছিলাম। এখন তো দেখছি শুধু গরু দু’টোই ভরসা। ওদের দুধ বেচে কোনও রকমে সংসার চলছে। আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। জমির টাকা দিলেই খুশি হয়ে নিয়ে নেব।”
মধ্যপাড়ার বৃদ্ধ ‘অনিচ্ছুক’ চাষি পাঁচু ঘোষের পাঁচু বিঘে জমি গিয়েছে। কী ভাবছেন এখন, প্রশ্ন করতেই বাঁকা হাসলেন। বললেন, “যা ভাবছি, বলতে পারব না। তা হলে সরকারি সাহায্যটুকুও আর জুটবে না!” খানিক চুপ থেকে পরে নিজেই বলেন, “সত্যি বলতে কী, আমাদের আর হারানোর কিছু নেই। এখন জমির টাকা নিয়ে নিলেই বাঁচি।”
তবে সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের এই অংশটিই নয়, জমি দিয়ে যাঁরা টাকা নিয়েছিলেন, সেই ‘ইচ্ছুক’ চাষিরাও দীর্ঘ টানাপোড়েনে হতাশ। অনেকে সুদে-আসলে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে জমি ফেরত চাইছেন।
চার বিঘে জমি টাটাদের দিয়ে তিন লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন যুধিষ্ঠির ঘোষ। তাঁর সাফ কথা, “কারখানা হবে বলে জমি দিয়েছিলাম। এলাকার উন্নয়ন হত তাতে। অনেকে কাজ পেত। কিন্তু কোথায় কী! জমি বেচে যে টাকা পেয়েছিলাম, তাতে ক’দিন বসে খাব? মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে চাই, কারখানা হলে ভাল। না হলে জমি ফেরতের ব্যবস্থা করুন। ফের চাষ করে খাব। যে টাকা পেয়েছিলাম, সে সব না হয় সুদে-আসলে ফেরতও দিয়ে দেব!”
সাউপাড়ার শ্রীচরণ সাউও জমি দিয়ে টাকা নিয়েছিলেন। এখন বলছেন, “কারখানা হলে ছেলেপুলের কাজ জুটত। তা তো কিছুই হল না। আদৌ হবে কি না জানি না। এখন জমি ফেরত পেতে চাই। মামলা একবার আইন-আদালত পর্যন্ত গড়ালে কখনও কিছু হয় নাকি? মুখ্যমন্ত্রী কি সে সব বোঝেননি? জেদাজেদি না করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেললেই ভাল করতেন। যদি সুযোগ পাই, শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীকে গিয়ে সে সব কথা বলব।”
বাজেমিলিয়া, বেড়াবেড়ি, গোপালনগর জমি আন্দোলনের দিনগুলিতে যেখানকার অসংখ্য মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরাই এখন উল্টো সুর গাইছেন। দীর্ঘ আন্দোলনে একই সঙ্গে হতাশা এবং ক্লান্ত তাঁরা। তার উপরে সংসারে হাঁড়ির হাল।
সিঙ্গুরবাসীর ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ আঁচ করেই মাস কয়েক আগে সরকারি সাহায্যের চাল-টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেই টাকাও গত চার মাস ধরে পান না ‘অনিচ্ছুক’ চাষি-খেতমজুরেরা। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছে। জমি আন্দোলন পর্বের দুই মুখ, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও বেচারাম মান্নার তরজা তাঁদেরও আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিল বলে মনে করছেন অনিচ্ছুকরা।
‘অনিচ্ছুক’দের ক্ষোভ-হতাশা ‘সঙ্গত’ মনে করলেও বেচারামবাবু এ দিন বলেন, “আমাদের আন্তরিকতায় কোনও ত্রুটি নেই। দিদি সকলকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। অনিচ্ছুকদের জমি ফিরিয়ে দিতে সরকার ও দল অঙ্গীকারবদ্ধ।”
আর ‘মাস্টারমশাই’ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। এখন সংযম বজায় রাখা দরকার। আমার কাছে যাঁরাই এসেছেন, তাঁদের সংযত থাকতে বলেছি।”সিঙ্গুরে যে জমি আন্দোলনের নৌকোয় পা রেখে বিধানসভা ভোটের বৈতরণী পার করলেন মমতা, ‘অনিচ্ছুক’দের উল্টো সুর সেই আন্দোলনেরই যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় তৈরি করল। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভার ঠিক আগের দিন সমাপ্তিদের ক্ষোভ সিঙ্গুরে অন্য এক আন্দোলনের সূচনা কিনা, সেই প্রশ্নও উঠে গেল।
—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.