|
|
|
|
ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে তদন্তের সুপারিশ যাচাইয়ের জালে |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য |
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ ছিল, কার্টুন-কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের দুই ‘অভিযুক্ত’ অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র ও অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত সেনগুপ্তকে। কিন্তু রাজ্য সরকার এখনও কোনওটাই মানেনি। উল্টে ‘অভিযুক্ত’ অফিসারদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে যাচাই করতে দেওয়া হয়েছে কমিশনের সুপারিশ।
কমিশন বলেছিল, পূর্ব যাদবপুর থানার দুই অফিসার মিলন দাস ও সঞ্জয় বিশ্বাস যে ভাবে অম্বিকেশবাবু-সুব্রতবাবুকে গ্রেফতার করেছিলেন, তা ঠিক ছিল না। উপরন্তু বিচারযোগ্য নয় (নন কগনিজিব্ল), এমন অভিযোগের ভিত্তিতে যে ভাবে ওঁদের রাতভর থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল, তা-ও মানবাধিকার হরণের নামান্তর বলে কমিশনের অভিমত। অন্য দিকে পুলিশ-কর্তারা কমিশনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, উত্তেজিত জনতার হাত থেকে বাঁচাতেই দু’জনকে ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও ‘নিরাপদ আশ্রয়’ বলতে কী বোঝায়, কোনও পুলিশ-কর্তা তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বলে কমিশনের দাবি।
মহাকরণ সূত্রের খবর: কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পরে তার ‘যৌক্তিকতা যাচাইয়ের’ উদ্দেশ্যে কলকাতার পুলিশ কমিশনার (সিপি) রঞ্জিত পচনন্দাকে ফাইলটি পাঠায় স্বরাষ্ট্র দফতর। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “কার্টুন-কাণ্ডে থানার দুই অফিসার কমিশনের চোখে দোষী হলেও স্বয়ং কমিশনারের মনোভাব জানা জরুরি। দুই অফিসার পুলিশি-এক্তিয়ারের বাইরে কাজ করেছিলেন কি না, সে সম্পর্কে সিপি’র মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়েছে।”
কিন্তু দেড় মাসের বেশি গড়িয়ে গেল, সে ফাইল লালবাজারে পড়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার বহু বার পচনন্দার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস করেও পাওয়া যায়নি কমিশনারের উত্তর।
সিপি-র প্রতিক্রিয়া না-মিললেও কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য চাওয়াকে ঘিরে ইতিমধ্যে রাজ্য প্রশাসনে প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক অফিসারের বক্তব্য, “যেখানে পুলিশ কমিশনার নিজেই ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে কমিশনে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেখানে ফের তাঁর বক্তব্য জানা কতটা জরুরি?” এমনকী, একই বাহিনীতে থাকা উর্ধ্বতন অফিসার নিচুতলার কর্মীকে আদৌ দোষী সাব্যস্ত করবেন কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন প্রশাসনের একাংশ।
মানবাধিকার কমিশনের কাছে কী বলেছিলেন পুলিশ কমিশনার?
রাজ্য সরকারকে পাঠানো রিপোর্টে কমিশন জানিয়েছে, রঙ্গচিত্র-কাণ্ডে সিপি-র পেশ করা রিপোর্টে তাঁর নিজের একটি মুখবন্ধ ছিল। তাতে সংশ্লিষ্ট কার্টুন সম্পর্কে ‘সুপারইম্পোজড’, ‘ডিকম্পোজড’, ‘ক্রিমিন্যাল ইনটেন্ট’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু ‘ডিকম্পোজড’ ও ‘ক্রিমিন্যাল ইনটেন্ট’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কমিশনে সাক্ষ্যদানের সময়ে সিপি তা ব্যাখ্যা করতে পারেননি বলে কমিশনের দাবি।
প্রসঙ্গত, পচনন্দার সাক্ষ্যের দু’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে পোস্ট করা রঙ্গচিত্রটি সম্পর্কে ওই শব্দগুলি ব্যবহার করেছিলেন। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের অনুমান, মুখ্যমন্ত্রীকে অনুসরণ করেই পুলিশ কমিশনার তাঁর রিপোর্টের মুখবন্ধে ‘ডিকম্পোজড’ বা ‘ক্রিমিনাল ইনটেন্ট’-এর মতো শব্দ বসিয়েছেন। এক পুলিশ-কর্তার কথায়, “পুলিশি ভাষায় ডিকম্পোজড বলতে পচা-গলা বোঝায়। কিন্তু কোনও ছায়া-ছবি এমন অবস্থায় পৌঁছতে পারে, এমনটা আমার ধারণার বাইরে।”
পরবর্তী কালে কার্টুন-মামলায় ‘ক্রিমিন্যাল ইনটেন্ট’ বা অপরাধমূলক উদ্দেশ্য সংক্রান্ত মূল ধারাটি চার্জশিট থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বাদ পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মানহানি সংক্রান্ত অভিযোগও। মহাকরণের এক পুলিশ-কর্তার ব্যাখ্যায়, “এই জাতীয় মামলায় যাঁর মানহানি হয়েছে বলে অভিযোগ, তাঁকেই সরাসরি আদালতে নালিশ জানাতে হবে। তিনি না-পারলে আবেদন করবেন তাঁর কোনও পরিজন। অম্বিকেশ-কাণ্ডে এর কোনওটাই হয়নি।” পুলিশ-কর্তাদের একাংশের মতে, কার্টুন-কাণ্ডে আগু-পিছু না-ভেবে ওই ধারাটি জুড়ে দেওয়ায় আদালতে পুলিশের অভিযোগ ধোপে টিকত না। আর তা আঁচ করেই চার্জশিট থেকে মানহানির ধারাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
এর পরেও অবশ্য রাজ্য সরকারের কাছে বিশেষ কিছু আশা করছেন না অম্বিকেশবাবু। তিনি বলছেন, “বালাসাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পরে মুম্বইয়ে অঘোষিত বন্ধ নিয়ে ফেসবুকে কটাক্ষ করায় ক’দিন আগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে দুই তরুণীকে গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্রের পুলিশ। এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কি প্রতিকার আছে?” যাদবপুরের ওই শিক্ষক বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণ না-মেলায় বিষয়টি তিনি মানবাধিকার কমিশনের নজরে এনেছেন। কমিশনের সুপারিশ না-মানায় তিনি এ বার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অম্বিকেশবাবু। |
|
|
|
|
|