আমার মুক্তি আলোয় আলোয় ছোট্টছোট্ট কয়েকটি কচিকাঁচাদের গলায় ভেসে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাদের একপাশে দাঁড়িয়ে তখন চোখে জল হেড স্যারের।
‘হেড স্যার’ রাধানাথ মুখোপাধ্যায়। এক নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের সামান্য হেডমাস্টার। দুবরাজপুর থানার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছু শিশুর মুখে গানের বুলি ফুটিয়ে তাদের সামান্য জীবনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। সেই ‘হেড স্যার’ রাধানাথবাবুকে নিয়েই নতুন চলা শুরু করেছে হাজরাপুর নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল।
শুরুটা অবশ্য হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত শেখানো দিয়ে। তখন ২০০৯। স্কুল সার্ভিস কমিশন দিয়ে রাধানাথবাবু যখন এই স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হয়ে ‘টিচার ইনচার্জ’ পদে যোগ দিলেন, তখন স্কুলের কোনও নিজস্ব ভবনও ছিল না। পড়াশোনা হত স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খোলা প্রাঙ্গণেই। পড়ুয়া বলতে ওই প্রাথমিক স্কুলেরই চতুর্থ শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ জনা পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী। রাধানাথবাবু ছাড়া শিক্ষক আর একজন। ছেলেমেয়েদের বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। গাছে ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে ফাঁকা জায়গাতেই চলত ক্লাস। ঝড়-বৃষ্টি-বাদলায় অবশ্য বন্ধ হয়ে যেত সেই ক্লাস। প্রায় ছ’ মাস ওই ভাবে চলার পর হাজরাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে তৈরি হতে লাগল স্কুলের নিজস্ব ভবন। কিন্তু এত অসুবিধার মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের বে-সুরে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দেখে অস্বস্তি হত রাধানাথবাবুর।
অস্বস্তি তো হবেই! |
রাধানাথবাবু নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, গোরা সর্বাধিকারী-র (বিশ্বভারতীর সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ) এই ছাত্র শান্তিনিকেতন দূরদর্শন কেন্দ্রেরও নিয়মিত শিল্পী। তাই প্রাথমিক স্কুলের হারমোনিয়ামটা চেয়ে নিয়ে বসে পড়েছিলেন ছাত্রছাত্রীদের সুরে জাতীয় সঙ্গীত শেখানোর কাজে। তারপর কেটেছে অনেক দিন। ২০১১ সালে স্কুল পায় নিজস্ব ভবন। ক্লাসও পোঁছেছে পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণিতে। স্কুলের জন্য কেনা হয়েছে নিজস্ব হারমোনিয়ামও। জাতীয় সঙ্গীত শেখানোতেই অবশ্য থেমে থাকেননি রাধানাথবাবু। ছাত্রছাত্রীদের আরও অনেক ধরনের গানেই আগ্রহী করে তোলার কাজে মেতেছেন।
ওই পড়ুয়াদের প্রিয় ‘হেড স্যারে’র কথায়, “বেশ কিছু দিন লেগেছিল ওদের ঠিক করে গেয়ে উঠতে। ছাত্রছাত্রীরা যখন জাতীয় সঙ্গীতটা ঠিক করে গাইতে পারল, তখন মনে হল এখানেই কেন থেমে যাওয়া!” তাই এরপরে রাধানাথবাবু তাদের একে একে শেখালেন দিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথের গান। রাধানাথবাবু বলেন, “ওরা আমাকে নিরাশ করেনি। যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে ঢের ভাল গেয়ে শুনিয়েছে ওরা।”
মূলত অর্থনৈতিক ভাবে পেছনের সারিতে থাকা পরিবারের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে পড়ে। পরিবারের অনেকেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এমন পরিস্থিতি থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর পাশাপাশি গানের প্রতি আগ্রহী করে তোলাটা কঠিন কাজ তো বটেই। সেই কাজটাই সহজ করে দেখিয়েছেন রাধানাথবাবু। জানালেন, “গান শেখার পালা শুরু হওয়ার পর থেকে স্কুলে শনিবারে উপস্থিতির হার বেড়ে গিয়েছে।” শুধু কি তা-ই? তাঁর দাবি, “গান তাদের জীবনে একটা ‘রিলিফ’-এর কাজও করেছে। উন্নতি হয়েছে পড়াশোনাতেও।” তাই এখন নিয়ম করে শনিবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান শেখাতে বসেন ‘হেড স্যার’।
রাধানাথবাবুর কথাটা যে মিথ্যে নয়, এক শনিবার ওই স্কুলে গিয়েই টের পাওয়া গেল। ক্লাসঘরের ব্ল্যাকবোর্ডে তখন লেখা ‘সব দিবি কে সব দিবি পায়’ গানটি। সামনে বসে নানা ক্লাসের ছেলেমেয়েরা। এক পাশে দাঁড়িয়ে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন রাধানাথবাবু। গানে গলা মিলিয়েছে সকলেই। ছিলেন আর দুই শিক্ষক বাপ্পাদিত্য সেন ও উজ্জ্বল সাহাও। পড়ুয়াদের আনন্দে সামিল হয়ে বললেন, “লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরা এমন কিছু শিখলে শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে তাদের একটা পরিচয় তৈরি হয়। তার থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে!” আর গান শেখার ফাঁকে উৎফুল্ল শেখ সুমন, বিক্রম বাগদি, সানোয়ারা খাতুন ও সুকন্যা মণ্ডলেরা বলে, “শনিবার মানে গান! পড়াশোনার মাঝে এই দিনটা তাই আমাদের ভীষণ প্রিয়।” স্কুল থেকে বেরিয়ে বাইরে এসেও অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল গান। একদল স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে ভেসে আসছিল ‘সব দিবি কে সব দিবি পায়’। রাধানাথবাবুর স্বপ্ন এখন কেবল নিজের নয় একদল উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরও! |