নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, রৌদ্রছায়া, কাশফুল আর ঝরা শিউলি দেখলেই ইচ্ছে করে পালাই পালাই। সঙ্গে কয়েক জন বন্ধু বা জনা কয়েক আত্মীয়স্বজন। শরতের সোনা রোদ গায়ে মেখে ভ্রমণের আনন্দে ভেসে যাওয়া।
আমাদের দলটা পাঁচ জনের জিষ্ণু, সৌমি, জয়শ্রী, সুশান্ত ও আমি। ২০ অক্টোবর সকালে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য আরব সাগরের তীরে কেরল। তবে সরাসরি নয়, চেন্নাইয়ে একটু থেমে। ম্যারিনা বিচ দেখে কেরলের কোভালম ও শানগুমুঘাম, ভারাকালা সৈকতে। আসানসোল থেকে নিউ জলপাইগুড়ি-চেন্নাই এক্সপ্রেসে চড়ে রওনা দিলাম। এক রাত ট্রেনে কাটিয়ে চেন্নাই সেন্ট্রাল। সেখানে দু’দিন কাটিয়ে পৌঁছে গেলাম কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরম। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরের নীল জলে একফালি একাদশীর চাঁদের মতো কেরল রাজ্য। লম্বায় ৫৫০ কিলোমিটার, আর চওড়ায় মাত্র ১২০ কিলোমিটার। সজল-সবুজ-সুন্দরী কেরল যেন বাংলারই প্রতিছবি।
সহ্যাদ্রি পর্বতের সাত পাহাড়ে মনোরম প্রকতির মাঝে গড়ে উঠেছে ‘প্লেজার গার্ডেন অফ সাউথ ইন্ডিয়া’ তিরুঅনন্তপুরম শহর। এখানে রেল স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড মুখোমুখি। থাম্পানুর এলাকায় একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। প্রথম দিন বিকেলে স্টেশন থেকে প্রি-পেড অটো নিয়ে পৌঁছে গেলাম সাত কিলোমিটার দূরে এয়ারপোর্ট লাগোয়া শানগুমুঘাম বিচে। দীর্ঘ বিচ জুড়ে মেলা বসে গিয়েছে। সূর্যাস্ত দেখতে ঠাসা ভিড়। পর্যটক বিনোদনের নানা ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। সাগর পারে কানাই কুনহিরমনের তৈরি মৎস্য কন্যার ভাস্কর্য অনন্য। সৈকত দেখে দোতলা বাসে চেপে শহরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হোটেলে ফিরে এলাম। |
পরের দিন সকালে মিনিট দশেক হেঁটে পৌঁছলাম পদ্মনাভস্বামী মন্দির। হস্ট ফোর্ট (মিউনিসিপ্যাল) বাসস্ট্যান্ডের বিপরীতে এই মন্দির। ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের গৃহদেবতা এই পদ্মনাভস্বামী অর্থাৎ বিষ্ণু। প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে ঢুকতেই ৩০ মিটার উঁচু গোপুরম। লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরে খালি গায়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। সামনেই সোনায় মোড়া সেগুন কাঠের মিনারে ভাস্কর্যমণ্ডিত কুলশেখর মণ্ডপ। আছে মিউজিক্যাল পিলার। চারপাশ বিশাল অলিন্দে ঘেরা। মাঝখানে বিষ্ণু মন্দির। কালো কষ্টি পাথরের অনন্ত শায়নে বিশাল বিষ্ণুমূর্তি। মাথার উপরে ছত্রাকারে ফণা তুলে অনন্তনাগ আর পায়ের কাছে দেবী লক্ষ্মী, মস্তকে ধরিত্রী। মন্দিরের বাইরে সুন্দর ফ্রেস্কোর কাজ।
সে দিন বিকেলে ঘুরে নিলাম কোভালম সৈকত। আবর সাগরের দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। পান্না সবুজ টলটলে জলের মাথায় হিরের কুচি। তিনটি ধনুকাকৃতি বেলাভূমি সমুদ্র বিচ, ইভ বিচ, লাইটহাউস বিচ ঘুরে দেখলাম। বিচের ধারের নারকেল বীথিকায় ছাওয়া সবুজ টিলা। বিচগুলি বেশ পরিচ্ছন্ন। এখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বেশি। সোনালি সৈকতে উষ্ণ ভালোবাসার ছোঁয়া। সমুদ্রে স্নান সেরে রেস্তোরাঁয় সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নিতে নিতে আরব সাগরের বুকে সুর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম হোটেলে।
পরের দিন সকালে আবার প্রি-পেড অটো নিয়ে পৌঁছলাম শহরের কেন্দ্রে অবজারভেটারি পাহাড়ে ৮০ একর জায়গা নিয়ে তৈরি পার্ক ভিউ অঞ্চলে। গাছপালা দিয়ে সাজানো সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন এলাকা। এখানে একই চত্বরে জ্যু, বোটানিক্যাল গার্ডেন, আর্ট মিউজিয়াম, শ্রীচিত্রা আর্ট গ্যালরি। আলাদা আলাদা টিকিট কেটে মিউজিয়াম, জ্যু দেখলাম। এখানকার নেপিয়ার মিউজিয়াম ভবনটির গঠনশৈলী অসাধারণ। বর্ণাঢ্য মিনারের ভবনটির রঙিন কাচের জানলা, কাঠের সিলিং, টালির ছাদ, খিলান সবেতেই অভিনবত্ব আছে। ব্রোঞ্জ মূর্তির সংগ্রহ দুর্দান্ত।
পরের দিন প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে চলে গেলাম ভারকালা। দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। সৈকত সুন্দরী ভারকালা যেন কোনও এক অদৃশ্য শিল্পীর হাতে তৈরি নিখুঁত চিত্রপট। সুউচ্চ মাউন্টেন ক্লিফের বাঁকে নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছ। নীচে অর্ধচন্দ্রাকার সৈকত। কোনও বিশেষণের তোয়াক্কা না করে স্বমহিমায় বিরাজমান। সাউথ ক্লিফ টু নর্থ ক্লিফআধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পাপনাশম সৈকত। স্বর্ণালি বেলাভূমি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। নীল জল আর লাল টিলার পটভূমিতে ভারকালা হয়ে উঠেছে মোহময়ী।
ফিরে এলাম। তবু কেরল থেকে গেল সঙ্গেই।
|