হর্ষ ভাষ্যে
১) খেলাটা ভাল জানতে হবে
এঞ্জিনিয়ার হতে গেলে যেমন অঙ্কটা জানতেই হবে। তেমনি ক্রিকেট কমেন্ট্রি করতে গেলে ক্রিকেটটা বুঝতে হবে। সেই জ্ঞানটা দারুণ জাহির করলে চলবে না। আবার জ্ঞানটার অভাব থাকলেও চলবে না। দুইয়ের মাঝামাঝি থাকতে হবে। কিন্তু খেলাটা দারুণ না বুঝলে কমেন্ট্রিতে এগোনোই যাবে না। আর লাইভ টিভি এমন একটা মাধ্যম যেখানে এডিটিংয়ের কোনও ব্যাপার নেই। সে দিন আমি মুম্বই টেস্টের সময় মুগ্ধ হয়ে শেন ওয়ার্নের কমেন্ট্রি শুনছিলাম। যে ভাবে প্রত্যেকটা ডেলিভারির আগে ব্যাটসম্যানের মন বিশ্লেষণ করছিলেন, অনবদ্য। তরুণরা যারা কমেন্টেটর হতে চায়, তাদের খেলাটা খুব ভাল করে বুঝতেই হবে। রাহুল দ্রাবিড় আর একজন। উফ, কী বলে! ক্রিকেটটা যেন গুলে খেয়েছে।

২) পেশার জন্য ভালবাসা
ভীষণ জরুরি। খেলাটাকে সত্যিই ভালবাসতে হবে। আর খেলাটা থেকে এক্সাইটমেন্ট পেতে হবে। একটা ভাল কভার ড্রাইভ দেখে যেন সত্যিই মনটা ভেতর থেকে ভরে যায়। মুম্বই টেস্টে পিটারসেন ব্যাট করার সময় সৌরভকে লক্ষ করছিলাম। কী এক্সাইটেড! ওঝাকে কভারের ওপর দিয়ে পিটারসেন ছয় মারল। সৌরভের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন এই প্রথম ক্রিকেট দেখছে। এই প্যাশনটা চাই-ই।

৩) ভাষার ওপর দক্ষতা
এটাও ভীষণ জরুরি। ম্যাচ চলাকালীন বড় বড় মুহূর্ত তৈরি হবে। সেটাকে যথেষ্ট ফুটিয়ে তোলার জন্য যেন তোমাদের ভাষার ওপর দখল থাকে। টিভি কমেন্ট্রিতে মোমেন্ট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। মোমেন্ট মিস করলে চলে না। তোমার চোখের সামনে হয়তো তেন্ডুলকরের শততম সেঞ্চুরি হচ্ছে। আর তুমি কি না ঠিক ভাষাটা ওই সময় খুঁজে পাচ্ছ না। তা হলে তো গেল। মাঠে ব্যাটসম্যানকে যেমন পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক শটটা বার করতে হয়, ঠিক তেমনিই ভাষ্যকারকে ঠিক শব্দটা বার করতে হয়। ঠিক অভিব্যক্তিটা বার করতে হয়। ব্যাটসম্যানের অস্ত্রাগারে যেমন অস্ত্র তুলে রাখা থাকে, ভাষ্যকারের ভাঁড়ারে তেমনি কিছু শব্দ রেখে দিতে হয়।

৪) এনার্জি
কমেন্ট্রিতে এনার্জি প্রায়ই দরকার পড়ে। গলাটার মধ্যে একটা এক্সাইটমেন্ট এলে তবেই না তুমি শ্রোতাকে বসিয়ে রাখতে পারবে। তোমার নিজের গলাই যদি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তুমি নিজেই যদি উৎসাহ না পাও, তা হলে লোকে বসে শুনবে কেন? এনার্জিটা অবশ্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ে। সৌরভ যখন প্রথম শুরু করেছিল, কেউ কেউ বলত ওর বিশ্লেষণ দারুণ কিন্তু গলায় এনার্জিটা একটু কম। এখন দেখবেন সৌরভ এটা কাটিয়ে উঠেছে। এখন কথা হচ্ছে রাহুলকে নিয়ে। আমি নিশ্চিত পরের মরসুমের আগে রাহুলের গলাতেও দারুণ এনার্জি এসে যাবে।
বক্স অফিস: কে কী বলেন এবং কেন?
 
 

৫) হাস্যরস
রসবোধ কমেন্ট্রির মধ্যে থাকা খুব কাজে দেয়। কেউ যদি এমন থাকে যে কথা বলতে বলতে টুকটাক চুটকি ছাড়ছে, তা হলে প্রোডিউসারকে খুশিই করবে। তবে টিভিতে লম্বা কথা বলার সুযোগ যেহেতু কম, হিউমারগুলো ছোট ছোট রাখতে হবে। আশ্চর্যজনক ভাবে রাহুলের মধ্যে শুকনো হাস্যরসটা প্রচুর পরিমাণে আছে। ওকে দেখলে এমনিতে খুব গম্ভীর মনে হয়। কিন্তু টিভি বক্সে এ বার বেশ মজা করেছে। রাহুলকে আমার দারুণ লাগে।

৬)স্বতঃস্ফূর্ততা
স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারাটা এমন জিনিস যে ডিজাইন করে তৈরি করা সম্ভব নয়। আপনা থেকেই আসতে হবে। আর এলে এমন জিনিস যার মার নেই। আমার বহু বছর আগে টরন্টোর একটা শো-এর কথা মনে আছে। আমি, বয়কট আর টনি কোজিয়ার তিনজন ছিলাম ফ্রেমে। প্রচণ্ড ঠান্ডা। ওই ঠান্ডার জন্য বয়কট এমন একটা টুপি ব্যবহার করেছিলেন যা মাঙ্কি ক্যাপের মতো। আর তার ওপর দিয়ে একটা বিশাল হেডগিয়ার নীচ অবধি টানা। মাইক্রোফোন সামনে রাখতে গিয়ে দেখি বয়কটের নাক আর ঠোঁট ছাড়া আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। প্রশ্ন করব কী, লোকটাকে তো দেখতেই পাচ্ছি না। টনি তখন বলল, হিয়ার কাম্স দ্য ইনভিজিব্ল ম্যান! এটা শুনে আমি এত হাসতে শুরু করি যে কুড়ি সেকেন্ড সেই হাসি থামছিল না। প্রোডিউসার তখন ভয় পেয়ে যায় এ কী রে, হর্ষ এমন হেসেই চলেছে যে ও কথা বলবে কখন? পরে কিন্তু সবাই বলেছিল ওই মুহূর্তটা ওদের দারুণ লেগেছে। হঠাৎ করে যদি কোনও ছবি স্ক্রিনে চলে আসে, তখনই তার ওপর বলতে পারাও একটা স্বতঃস্ফূর্ত কৌশল। ১৯৯৯ চেন্নাই টেস্ট মনে পড়ে। পাকিস্তান ম্যাচ জিতে যাওয়ার পর আমি দর্শকদের বলছি, গুডবাই আপনাদের। দিল্লিতে দেখা হবে। এই সময় প্রোডিউসার টক-ব্যাকে বলল, দাঁড়াও শেষ কোরো না। হঠাৎ দেখলাম পাকিস্তান টিম মাঠে ভিকট্রি ল্যাপ দিতে শুরু করল। ঠিক তখুনি পাকিস্তানের ভারতকে হারিয়ে উঠে ভারতেরই মাঠে দেওয়া ভিকট্রি ল্যাপের ওপর ঠিক অভিব্যক্তি দিতে হবে। তখন কিন্তু নিছক ক্রিকেট জেনে চলবে না। এটা এমন জায়গা যেখানে বীরু সহবাগ হতে হবে। দ্রাবিড় নয়।

৭) প্রস্তুত হয়ে যাওয়া
ভাষ্যকারকে সব কিছু জেনে মাঠে যেতে হবে। নিক কম্পটন কে? কোথায় খেলে? এর আগে ওয়ান ডে-তে খেলেছে কি না? কোন কাউন্টির লোক? তার বাবা কে? যদি মনে হয় আমি যথেষ্ট তৈরি নই, তা হলে খেলার অনেক আগে মাঠে পৌঁছে স্ট্যাটিস্টিশিয়ান মোহনদাস মেননের সঙ্গে বসতে হবে। ওঁর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। অনেকেই সিধুর কোটেশনের বই নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু আমার কাছে এর অর্থ অন্য। আমার কাছে মানে দাঁড়াল, লোকটা তার মানে কতটা খেটে এসেছে। কতটা তৈরি হয়ে এসেছে।

৮) ইগোকে স্ট্যাম্প সাইজে নামিয়ে আনা
ভীষণ, ভীষণ জরুরি। টিভি কমেন্ট্রি এমন একটা মঞ্চ নয় যেখানে কেউ প্রতিদিন গোল করতে পারে। এটা টিম গেম। যার যে দিন গোল করার দিন, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। সাধারণত কমেন্ট্রি করে দু’জন। একজন মুখ্য কমেন্টেটর। আর একজন বিশ্লেষক। এ বার বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করার সময় হয়তো সেই ম্যাজিক মুহূর্তটা এসে উপস্থিত হল যার জন্য সবাই সারা দিন বসে ছিল। তখন কিন্তু মুখ্য কমেন্টেটরকে বিশ্লেষককে থামিয়ে কথা বললে চলবে না। ধরে নিতে হবে ওটা ও পেয়েছে। ওটা ওরই গোল। ফুটবলে যেমন যে গোল করার জন্য সবচেয়ে ভাল অবস্থায় থাকে, তাকে দিয়েই গোল করানো হয়, ধারাভাষ্যেও তাই।

৯) দর্শকের নাড়ি বোঝা
এই একটা জায়গা যেখানে আমাদের অনেক ক্রিকেটারকে আমি গড়াগড়ি খেতে দেখেছি। অনেককে এটাও দেখেছি যে তারা মনে করে তাদের মাপের ক্রিকেট সবাই বুঝবে। কিন্তু দর্শক তো সব বোঝে না। কেউ বলে দিল ওপেনিং দ্য শোল্ডার। এ বার ওপেনিং দ্য শোল্ডার মানেটা কী, সেটা তো বলতে হবে। বহু বছর আগে এক বিদেশি ভাষ্যকারের সঙ্গে মস্ত বড় এক স্পোর্টস প্রোডিউসারের খুব ঝামেলা হয়েছিল। ভাষ্যকার বলেছিলেন, আরও দশ গজ পিছিয়ে ফিল্ডারটাকে স্কোয়ার লেগে নিয়ে যাওয়া হল। প্রোডিউসার তখন টক-ব্যাকে বলেছিলেন, ব্যাখ্যা করো, কেন ফিল্ডারকে পেছোনো হল। ভাষ্যকার কোনও পাত্তাই না দিয়ে বলতে থাকেন, দর্শক জানে কেন পেছনো হল। প্রোডিউসার খুব রেগে গিয়ে বলেন, আমি বলতে পারি আমার মা অন্তত জানেন না। এটা একেবারেই আশ্চর্যের নয় যে ওই ভাষ্যকারকে দ্রুতই ওই চ্যানেল ছেঁটে ফেলে।

১০) শৃঙ্খলা
অসম্ভব শৃঙ্খলা দরকার এই পেশায়। একটা হল প্রোডিউসার যা বলবে তা কোনও প্রশ্ন না করে পালন করার শৃঙ্খলা। যদি বলে দু’বার পিচ রিপোর্ট করো তো দু’বার পিচ রিপোর্ট করতে হবে। যদি বলে এখন যে দৃশ্যটা দেখানো হচ্ছে চুপ থাকো, তো চুপ থাকো। শৃঙ্খলা হল এই বাস্তবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যে, আসল হিরো হল টেলিভিশন। তুমি নিছকই তার একটা উপাদান। তোমায় যদি বলা হয় এই ছবির সঙ্গে গোটা কুড়ি শব্দ যাবে, তা হলে গোটা কুড়ি শব্দই যাবে। তা নিয়ে কোনও ধানাইপানাই করলে চলবে না। ব্যাটসম্যানকে যেমন জানতে হয় তার অফস্টাম্পটা ঠিক কোথায়, ভাষ্যকারকেও সব সময় মাথায় রাখতে হয় আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.