ভাতের পাতে সুবাস ফেরাতে কোমর বাঁধছে রাঁধুনিপাগলেরা
ধোঁয়া ওঠা ভাতে ম ম করছে চাঁপা ফুলের গন্ধ!
“হবেই তো। চালটার নামই যে কাঁঠালিচাঁপা।” বলছেন প্রবীণেরা। তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, আসল জয়নগরের মোয়ার মনমাতানো গন্ধের পিছনেও অবদান একটি ধানের। কনকচূড়। তার খইয়ে তৈরি মোয়ার স্বাদ দশগুণ বেড়ে যায় খইয়েরই সুবাস-গুণে। যেমন মৌলতা ধানের ভাতে ভরপুর থাকে কস্তুরীর ঘ্রাণ!
কিন্তু এখন সে সব স্বপ্ন-স্মৃতি।
শুধু কাঁঠালিচাঁপা, কনকচূড়, মৌলতা নয়, বাংলার ঐতিহ্যবাহী বহু সুগন্ধি চাল কার্যত বিলুপ্ত। দুধরাজ, কৃষ্ণশালি, চন্দনশালি, মধুমালতী-র মতো প্রায় একশো ধরনের চালের মৌতাত-মাখা ভাতের স্বাদই পায়নি নতুন প্রজন্মের রসনা। তবে সুখবর, প্রবীণদের আক্ষেপ ঘোচাতে রাজ্য এ বার উদ্যোগী হয়েছে। কী ভাবে?
রাজ্যের কৃষি-সচিব সুব্রত বিশ্বাস বলেন, “আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য, যতটা সম্ভব সুগন্ধি চালের বীজ সংগ্রহ। আপাতত আমরা পাঁচ রকম চাল বেছে নিয়েছি। রাধাতিলক, বাদশাভোগ, সীতাভোগ, গোবিন্দভোগ ও তুলাইপাঞ্জি।” সচিব জানাচ্ছেন, এ বছর খরিফ মরসুমে দফতরের তত্ত্বাবধানে উত্তর দিনাজপুর, নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি ও উত্তর ২৪ পরগনা এই পাঁচ জেলায় মোট চল্লিশ হেক্টর জমিতে সেগুলোর চাষ হচ্ছে। যা ধান ফলবে, পুরোটাই বীজ হিসেবে চাষিদের থেকে দফতর কিনে নেবে, বাজারের বেশি দরে।
এবং সেই বীজের সাহায্যে আরও ব্যাপক আকারে, আরও নানা জায়গায় সুগন্ধি ধানের চাষ ছড়িয়ে দেওয়া কৃষি দফতরের পরিকল্পনা। দফতর-সূত্রের খবর: ৪০ হেক্টরের ফলন থেকে পাওয়া বীজ নিয়ে আগামী মরসুমে তিন হাজার হেক্টরে এই পাঁচ ধরনের সুগন্ধি ধানের চাষ করা হবে। সেই ফলনেরও পুরোটা কিনে একাংশ বীজ, আর বাকিটা চালের জন্য রাখা হবে।
কিন্তু নবীন কৃষকেরা প্রাথমিক চাষটা কী ভাবে করবেন?
কৃষি-সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁচ জেলায় দফতরের বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্র ও খামার থেকে পাঁচ রকম সুগন্ধি ধানের মোট আট কুইন্ট্যাল বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে চাষিদের। সঙ্গে পরিবেশবান্ধব সার-কীটনাশক-অণুখাদ্যের খরচ বাবদ হেক্টরপিছু ৪৬৭০ টাকা। চাষিদের বোঝানো হচ্ছে, সুগন্ধি ধানের চাষ যত জৈব-প্রযুক্তি নির্ভর ও পরিবেশ-বান্ধব হবে, তত বেশি ফিরবে তার নিজস্ব সুবাস।
চাষের এলাকা বিস্তারের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ধান ফলানোর ভাবনাও দফতরের আছে। কর্তারা জানিয়েছেন, নদিয়ার ফুলিয়ায় কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের খামারে গবেষণা চালিয়ে এ পর্যন্ত বাংলার দেশজ ২৮ রকম সুগন্ধি ধানের বীজ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোর চাষও শুরু হবে। তালিকায় রয়েছে রাঁধুনিপাগল, কালোনুনিয়া, রাধাভোগ, কাঁঠালিচাপা ইত্যাদি।
ঘটনা হল, সুবাসিত ধান গোলায় তুলতে সময় লাগে তুলনায় বেশি, যত্ন-আত্তির বহরও বিস্তর। বস্তুত অল্প সময়ে অধিক ফলন ঘরে তোলার তাগিদেই বাংলার সুগন্ধি চাল ক্রমশ বিলুপ্তির আঁধারে চলে গিয়েছে বলে কৃষি-মহলের একাংশের দাবি। এ অবস্থায় সুগন্ধি ধান ফলিয়ে চাষির বাণিজ্যিক লাভ কতটা হবে, তার উপরেও অনেকটা নির্ভর করছে পরিকল্পনাটির ভবিষ্যৎ। কৃষি-সচিব সুব্রতবাবু অবশ্য বলছেন, “সুগন্ধি ধান-চাষ প্রসারের অন্যতম উদ্দেশ্য, কৃষকেরা যেন ধান বেচে বেশি দাম পান। ওই চালের দাম বাজারে বেশি। বাংলার অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনলে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, গন্ধ-গুণে ভিন রাজ্যের বাসমতী-ই শেষ কথা নয়।”
কিন্তু সরকার তো চিরকাল চাষির কাছ থেকে চাল কিনবে না! তখন?
সচিবের দাবি: সরকার না-কিনলেও খদ্দেরের অভাব হবে না। “বাজারে এর চাহিদা যথেষ্ট। ইতিমধ্যে বঙ্গভবনের কাউন্টার থেকে গোবিন্দভোগ, তুলাইপাঞ্জি বিক্রির উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে। অনেকে সুগন্ধি চালের খোঁজে সরাসরি চাষির কাছে চলে আসবেন।” বলেন সুব্রতবাবু।
সুবাস ছড়ানো চালের জন্য আগ্রহী অবশ্য অনেকেই। এক রেস্তোরাঁ গোষ্ঠীর কর্ণধার অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, “সরকার চাইলে এই প্রয়াসে আমরাও সামিল হতে পারি। প্রয়োজনে আমরাই চাল বাজারদরে কিনে নেব।” অঞ্জনবাবুর কথায়, “আমাদের বাংলার সুগন্ধি চাল ভিন রাজ্যের বাসমতীর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। গোবিন্দভোগে রাঁধা বিরিয়ানি তো স্বাদে-গন্ধে অনন্য! সবচেয়ে বড় কথা, বাংলার চালের সুঘ্রাণ এতটাই আদি ও অকৃত্রিম যে, রান্নায় কৃত্রিম ভাবে সুগন্ধ ছড়ানোর প্রয়োজন হয় না।” কালোনুনিয়া বা কালোজিরের মতো চালের কথা মনে করে আফশোস করলেন ময়মনসিংহের জমিদারবাড়ির সন্তান ধৃতিকান্ত লাহিড়িচৌধুরী “কী সুন্দর গন্ধ ছিল তার! এখনকার লোকে তো ওই সব রাঁধতেই ভুলে গেছে!”
তবে সুগন্ধি চাল ফিরে এলে বাংলার পুরনো কিছু রান্নার প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে বলে আশারাখেন শোভাবাজার রাজবাড়ির গৃহিণী নন্দিনী দেব। যা ফিরিয়ে দিতে পারে খাবারের কুলীন স্বাদ। “অনেকের ধারণা, পায়েস ভাল হয় গোবিন্দভোগে। ওঁরা জানেন না, পায়েসের জন্য আদর্শ হল রাধাভোগ। গোবিন্দভোগের তুলনায় রাধাভোগ ছোট দানার। সুঘ্রাণও বেশি।” বলছেন নন্দিনীদেবী।
অন্ন-গন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার অপেক্ষায় রইল বাঙালির হেঁসেল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.