ডেভিড বুথ বললেন, “পোয়েটিক জাস্টিস।”
সালগাওকর সচিব রাজ গোমস বিরতিতে বলছিলেন, “দেখছিলেন করিমের বিরুদ্ধে কী ভাবে গ্যালারি ক্ষোভে ফুসছে। পোস্টারে কী লিখে এনেছে ওরা।”
চার্চিল প্রধান আলেমাও চার্চিল বললেন, “করিমের মোহনবাগানকে হারানোর জন্য ডেম্পো আগে থেকেই রেফারিকে ঠিক করে রেখেছে। ওডাফার পেনাল্টিটাও দিল না।”
গোয়ার দুই প্রধান ক্লাবের কর্তা-কোচের কথার নির্যাস যা তাতে স্পষ্ট — মোহনবাগান বনাম ডেম্পো নয়, বাংলা বনাম গোয়াও নয়, বুধবার রাতের ম্যাচটা ছিল করিম বেঞ্চারিফা বনাম ডেম্পোর। ডেম্পো দুর্দান্ত ফুটবল খেলে জেতার পর গ্যালারিতে যতটা না উচ্ছ্বাস আর্মান্দো কোলাসোর দলের জন্য, তার চেয়ে বেশি মনে হল সালগাওকর ছেড়ে যাওয়া করিমকে উচিত ‘শিক্ষা’ দেওয়ার স্বপ্ন সফল হওয়ার। কারণ, মাঠে নীল-সাদার চেয়ে বুথের দলের সমর্থকই ছিল অনেক বেশি। |
মারগাওয়ে আর্তনাদ। ছবি: উৎপল সরকার |
কোচ বনাম ক্লাবের এই চমকপ্রদ লড়াইতে শেষ পর্যন্ত দেশের সবথেকে দামি এবং অন্যতম সফল কোচ বিধ্বস্ত। তাঁর বিখ্যাত ‘ভাগ্য’-ও যে আজ সঙ্গী হল না গোয়ায়। হবেই বা কী করে? তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা সুস্থ সবল দলই তো পেলেন না। এ দিন আবার দ্বিতীয়ার্ধ শুরুর আট মিনিটের মাথায় বিশ্বজিৎ সাহা লালকার্ড দেখে বাইরে চলে গেলেন। সাইত্রিশ মিনিট দশ জনে খেলে কি বিরতিতে ২-০ পিছিয়ে পড়ার ব্যবধান কমানো যায়! সেটা তো হয়ইনি উল্টে তিরিশ গজ দূর থেকে গডউইন ফ্রাঙ্কোর দুর্দান্ত একটা গোল মোহনবাগানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিল। কার্যত শেষ করে দিয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াইতে থাকার স্বপ্ন।
গত বছর গোয়ায় আই লিগের এই ম্যাচে সুব্রত ভট্টাচার্যের মোহনবাগান ৫-০ হেরেছিল। শেষের দিকে যে ভাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিলেন সুয়েকা-জোয়াকিমরা, তাতে মনে হচ্ছিল সেই রেকর্ড না ভেঙে যায়। ম্যাচের পর করিমকে দেখে মনে হল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। থমথমে মুখ। গম্ভীর। গালে হাত দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ঠায় বসেছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। আর্মান্দো কোলাসো তখন তার ফুটবলারদের বুকে জড়িয়ে ধরছেন। সে দিকে না তাকিয়ে মোহন-কোচ ধীর পায়ে টানেল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন ড্রেসিংরুমে। পরে বলেও দিলেন, “সত্যি বলছি টিমটা যখন হাতে নিলাম তখনও ভাবিনি যে এ রকম অবস্থা হবে। এত চোট আঘাত। যে দিকে তাকাই সে দিকেই ইনজুরি।”
কিন্তু আপনার দল তো আজকের হারের পর চ্যাম্পিয়নশপের লড়াই থেকে ছিটকে গেল। করিম বলে দিলেন, “এক নম্বরের সঙ্গে ব্যবধানটা অনেকটা বেড়ে গেল। কিন্তু ফুটবলে তো সবই সম্ভব। এ বার যা অঘটন ঘটছে।” তীব্র ভূকম্পের মধ্যেও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার আশা নিয়ে যে ভাবে লড়াই চালান সেনারা, সে রকম লড়াই চালানোর ইচ্ছে শক্তি এখনও মনে হল অবশিষ্ট আছে মরক্কান কোচের। |
|
অব তেরা কেয়া হোগা করিম?
এক মোহনবাগান সমর্থক |
|
|
|
নবি-ইচে চোটের জন্য বাইরে। মেহরাজ-নির্মল-ডেনসন আধা ফিট। তার উপর গোয়ার তীব্র আর্দ্রতা। এর মধ্যেই হাতে যে অস্ত্রগুলো ছিল তার সফল প্রয়োগের চেষ্টা করেছিলেন করিম। এই মাঠেই বত্রিশ ঘণ্টা আগের অনুশীলনে সেই ফর্মেশন বেশ ঝকঝক করছিল। শুরুর মিনিট পনেরো সেটা কার্যকর হল। কিন্তু তার পর করিমের নামানো তিনটি অস্ত্রমেহরাজ, ফেলা আর সাবিথ কিন্তু ডাহা ফেল করে গেলেন। স্ট্যানলিও মাঝমাঠে কিছু করতে পারলেন না।
প্রথম গোল পুরোপুরি মেহরাজের দোষে। ডান দিক থেকে গোয়ার সবথেকে প্রতিভাবান মিডিও যাঁকে বলা হচ্ছে সেই রোমিও ফার্নান্ডেজের ক্রসটায় মোহনবাগানের কাশ্মীরি ডিফেন্ডার পা-ই লাগাতে পারলেন না। জোয়াকিম আব্রাঞ্চেজ গোলটা করে গেলেন। নির্মল ছেত্রী যে ফাউলটা নিজেদের বক্সে করলেন পিটার কার্ভালহোকে, সেটাও এড়ানো যেত। করিম বলছিলেন, “দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যখন লড়াইটা শুরু করলাম তখনই লালকার্ডটা হয়ে গেল। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট।” মোহন-কোচের এই দাবি অবশ্য মানা যাচ্ছে না। কারণ, আর্মান্দো তাঁর হাতে থাকা দলকে এমন ভাবে মাঠে নামিয়েছিলেন যাতে, করিমের কোনও অঙ্কই কাজে না লাগে। মোহনবাগানের ‘অর্জুন’ ওডাফাকে অভিমন্যুর মতোই চক্রব্যূহে ফেলে দিয়েছিলেন ডেম্পো-কেোচ। বারবার তাকে দেখা যাচ্ছিল উঠে গিয়ে রক্ষণকে সতর্ক করতে। তার মধ্যেই নিজের ক্যারিশমায় দু’টো গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন ব্ল্যাক-কোবরা। কিন্তু ৪-৪-২ ফর্মেশনে সাবিথ তো ওডাফাকে সাহায্যই করতে পারলেন না। লালরিন ফেলাও ফেল করে গেলেন উইং-এ।
ডেম্পোর স্ট্র্যাটেজি ছিল উইং দিয়ে মাঝেমধ্যে আক্রমণ তৈরি করা। এবং সুয়েকা-আব্রাঞ্চেজকে দিয়ে মোহন-রক্ষণে ঝাঁপানো। দু’টো স্ট্র্যাটেজিতেই মাত করে গেলেন দেশের সবথেকে সফল কোচ আর্মান্দো কোলাসো। ক্লাইম্যাক্স লরেন্স-কোকো না থাকা সত্ত্বেও গত বারের চ্যাম্পিয়নরা যা খেলল, তাতে মর্গ্যান-সুভাষ ভৌমিকের ঘুম কাড়ার পক্ষে যথেষ্ট। খেলার শেষে প্রথা মেনে করিমের সঙ্গে হাত তো মেলানইনি। উল্টে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে ডেম্পো কোচ বলে গেলেন, “মোহনবাগান সম্পর্কে একটি শব্দও বলব না। শুধু বলছি আই লিগে এটাই সেরা ম্যাচ। ছেলেদের কাছে আমি এই ম্যাচটাই চেয়েছিলাম। দারুণ খেলেছে। গডউইনের গোলটা দেখলেন। ম্যাচের আগে আমি ওকে বলেছিলাম তুমি আজ ম্যান অব দ্য ম্যাচ হবে।”
আর্মান্দো যখন টিম বাসে উঠছেন তখন স্টেডিয়ামের সিঁড়িতে বসে রয়েছেন ওডাফা। তাঁর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন ডেম্পো কোচ। কিন্তু ফিরেও তাকালেন না মোহনবাগান বাসের সামনের সিটে বসে থাকা করিম বেঞ্চারিফার দিকে। আধো আন্ধকারে দেখলাম মরক্কোন কোচ আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
মোহনবাগান: শিল্টন, নির্মল, মেহরাজ, আইবর, বিশ্বজিৎ, জুয়েল (মণীশ), স্ট্যানলি, ডেনসন, ফেলা (স্নেহাশিস), সাবিথ (রাকেশ), ওডাফা। |