অনেক দিন থেকেই ফুঁসছিল সিঙ্গুর। এ বার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল।
তৃণমূল নেত্রীর ডাকে যাঁরা এক দিন সর্বস্ব পণ করেছিলেন, সেই অনিচ্ছুক চাষি-খেতমজুর পরিবারের অনেকেই এই প্রথম প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দিলেন। আইনি জটের জেরে জমি ফেরত পাওয়ার আশা যে বিশ বাঁও জলে, সেটা বুঝতে পারছেন অধিকাংশ অনিচ্ছুকই। তাঁদের মন রাখতে চাল-টাকার যে সাহায্য সরকার ঘোষণা করেছিল, তা-ও আসছে অনিয়মিত। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমি আন্দোলনের দুই অন্যতম প্রধান মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও বেচারাম মান্নার তরজা। সব মিলিয়ে সিঙ্গুরের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। বুধবার কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারামকে সামনে পেয়ে অনিচ্ছুকরা তাই প্রশ্ন তুললেন, “জমি ফেরত দেবেন বলেছিলেন, তার কী হল? এখন আপনাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়েছে। আমাদের কথা কে ভাববে?”
কাল, শুক্রবার সিঙ্গুরে প্রশাসনিক বৈঠক করতে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তার আগে সমর্থকদের এই বিদ্রোহে স্পষ্টতই অস্বস্তিতে তৃণমূল নেতৃত্ব। |
এ দিন দলের তরফে চালের কুপন বিলির (নভেম্বর থেকে মার্চ) দায়িত্ব নিয়ে সিঙ্গুরে যান বেচারামবাবু। বেলা ১২টা নাগাদ তিনি যখন ব্লক অফিস চত্বরে পৌঁছন, তত ক্ষণে সেখানে হাজার চারেক মানুষের দীর্ঘ লাইন পড়ে গিয়েছে। বেচারামবাবুকে সামনে পেয়ে কেউ প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “গত চার মাস ধরে টাকা পাচ্ছি না, এই পরিস্থিতি শুধরোবে কবে?”
ক্ষোভ-বিক্ষোভে অপ্রস্তুত বেচারামবাবু দ্রুত টাকা পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। উল্টে সংবাদমাধ্যমের সামনে তৃণমূল নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করেছেন সিঙ্গুরবাসী। উষ্মা প্রকাশ করেছেন মমতার দীর্ঘদিন না-আসা নিয়েও।
অনিচ্ছুক চাষিদের অনেকেই এখন খোলাখুলি বলছেন, টাটাদের থেকে জমির টাকা নিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত। তাঁদেরই এক জন মায়া নাগের কথায়, “এখন বুঝেছি, জমি আর ফিরবে না। এর থেকে টাকা নিয়ে নিলে ভাল ছিল।” মায়াদেবীর আক্ষেপ, “রবীন্দ্রনাথবাবুকে কৃষি দফতরের দায়িত্ব দেওয়ায় আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভেবেছিলাম, সমস্যার সুরাহা হবে। কিন্তু কোথায় কী? এ বার বেচারামবাবুকে মন্ত্রী করল। এ সবই চলবে। আমাদের আর কিছু হওয়ার নয়।” শ্রীকান্ত ঘোষের কথায়, “আদালতের বাইরে মীমাংসা হলেই ভাল হত। কিন্তু সেই চেষ্টাই করল না আমাদের তৃণমূল সরকার।”
মন্ত্রী পরে বলেন, “২০০৬ সাল থেকে ওঁরা আন্দোলন করছেন। মানুষ ভেবেছিলেন, আমরা ক্ষমতায় এলেই রাতারাতি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা এখনও জমি ফেরত দিতে পারিনি। বিষয়টি আপাতত বিচারাধীন। কিন্তু এ সব কথায় তো মানুষের খিদে মানবে না।”
তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সিঙ্গুরবাসীর ক্ষোভ বাড়ছে বুঝে আসরে নেমেছে বিরোধী দলগুলিও। এ দিন সন্ধ্যায় বরাহনগরে এক সভায় সিপিএম নেতা গৌতম দেব রীতিমতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, “মমতাকে বলছি, আপনার খারাপ লাগে না, যখন ওই রাস্তা দিয়ে যান, সিঙ্গুর লাশকাটা ঘরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে? ওখানে তো আলো ঝলমল করার কথা ছিল।” মমতা জেদাজেদি ছেড়ে টাটাকে ডেকে আনলে সিপিএমের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাসও দেন গৌতমবাবু। বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যও আদালতের বাইরে মীমাংসা করে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সিপিএমের আক্রমণের উত্তরে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যেখানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরাই মস্তিষ্ক ঠিক রেখে কথা বলতে পারেন না, সেখানে আধা মস্তিষ্ক লোকের (গৌতম দেব) কথার জবাব দেব কী করে? মানুষই এর জবাব দেবে।” |
বিরোধীদের আক্রমণ গায়ে না-মাখলেও সিঙ্গুরের হতাশা ও ক্ষোভ কিন্তু আগে থেকেই চিন্তা বাড়াচ্ছিল তৃণমূল নেতৃত্বের। সেই কারণেই গত ১৯ মে মিলন মেলা প্রাঙ্গণে মুখ্যমন্ত্রী অনিচ্ছুক চাষি-খেতমজুরদের জন্য সরকারি সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই সাহায্যও ছিল অনিয়মিত। মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার সিঙ্গুর আসছেন বলেই এ দিন তড়িঘড়ি চালের কুপন বিলির সিদ্ধান্ত হয় বলে অনিচ্ছুক চাষিদের অনেকের ধারণা।
এ দিন সিঙ্গুর ব্লক অফিস থেকে যে ২ টাকা কেজি দরে চালের আগাম কুপন দেওয়া হবে, সরকারি ভাবে তার কোনও ঘোষণা হয়নি। মুখে মুখেই কুপন দেওয়ার কথা প্রচার হয়ে যায়। সকাল ১০টার আগেই শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করতে থাকেন ব্লক অফিসের বাইরে। মোট ৪০৯৬ জনকে এ দিন পাঁচ মাসের চালের কুপন দেওয়ার কথা ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনও বাড়তে থাকে। শ্রীকান্ত ঘোষ, প্রশান্ত আদকদের বেশ খানিকটা জমি টাটাদের প্রকল্প এলাকায় চলে গিয়েছে। কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে হতাশ শ্রীকান্ত, প্রশান্তদের বলতে শোনা গেল, “এক সময়ে মাঠের ধান বিক্রি করে আমাদের সংসার চলেছে। আর এখন সেই চালের জন্যই লাইন দিতে হচ্ছে।”
কিন্তু সরকারি সাহায্যের টাকাটাই বা নিয়মিত কেন পেলেন না অনিচ্ছুকরা? সরকারি সাহায্যের পরিমাণ (পরিবার-পিছু মাসে ১ হাজার টাকা ও ২ টাকা কেজি দরে ৮ কেজি চাল) নিয়ে শুরু থেকেই অসন্তোষ ছিল। বর্ধিত সাহায্যের দাবিতে মুখ খোলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। পরে সেই সাহায্য বাড়িয়ে পরিবার-পিছু মাসে ২ হাজার টাকা ও ১৬ কেজি চাল দেওয়ার কথা বলা হয়। বর্তমান বাজার-দরের নিরিখে সেই সাহায্যও নগণ্য বলে ক্ষোভ ছিল সিঙ্গুরের। কিন্তু গত চার মাস ধরে সামান্য সেই টাকাটুকুও না-পেয়ে অনিচ্ছুক চাষি-খেতমজুরদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। যা সামাল দিতেই এ দিন বেচারামবাবু বলেন, “সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টাকা এসে গিয়েছে। অবিলম্বে তা বিলি শুরু হবে।” হুগলির জেলাশাসক মনমীত নন্দাও বলেন, “ওঁরা বৃহস্পতিবারই টাকা পেয়ে যাবেন।”
কিন্তু সিঙ্গুর আর কত দিন ধৈর্য ধরবে, সে প্রশ্ন উঠেই গেল। |