রয়ান নামের গ্রাম। বোলপুর থেকে যে রাস্তাটা সিয়ান হাসপাতাল ছুঁয়ে নানুরের দিকে চলে গেছে, এ গ্রাম সে দিকেই। খুব দূরে নয়। কালীপুজোর আগে গ্রামের দিকে মুখ ফেরান কাজের জন্য গ্রামছাড়া মানুষেরা। রয়ানের কালীতলার পুজোর নাম-ডাক আশপাশের গ্রামগুলোতেও আছে। পুজোর দিন আশপাশের গাঁ-গঞ্জের লোক পুজো দেখতে ভেঙে পড়ে কালীতলায়। এই গ্রামের বিকাশবাবুর আমন্ত্রণে তাই এ বার চল পানসি রয়ান।
বিকাশবাবু উদ্যোগী, উদ্যমী ডিসিপ্লিনড মানুষ। মিলিটারি ম্যান। আর্মি থেকে অবসর নিয়েছেন, কাজ থেকে নয়। এখন ইন্ডিয়ান আর্মিতে আর নেই বটে, কিন্তু অবসরের পর অন্যত্র সিকিয়োরিটি অফিসার। পুজোর আগে পরে নিজের গ্রামে। পড়ে থাকা মাটির দোতলা বাড়ি ভেঙে, পুরনো কাঠামো যেটুকু বজায় রাখা যায়, রেখে, বাসযোগ্য পাকা ভদ্রাসন করে নিয়েছেন।
সেই বাড়ির লাগোয়া জমিতে কিচেন গার্ডেন। অর্ধগোলাকৃতি বসার জায়গা। মিষ্টি রোদ খেলছে। রাতের হিমের কথা ভেবে বসার জায়গার খুঁটি বরাবর টাঙানো হয়েছে চমৎকার রংচঙে শামিয়ানা। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা থেকে কেনা চেয়ারও রং করে রাখা। বাঁধানো বসার জায়গা ভরে গেলে সে চেয়ারে বসবেন পরিজনেরা। আজ পুজোর দিনে এ বাড়িতে নানা জনের আনাগোনা হবে, তাঁদের বসার জায়গা অকুলান হলে চলে? পৌষমেলার চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা জিজ্ঞাসা মাথার মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। ইতিহাসের পাতা আর পুরনো নথিপত্র উলটেপালটে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকার সময় এই আশপাশের গ্রামগুলির কথা খুবই গভীর ভাবে ভেবেছিলেন। কী ভাবে গ্রামের মানুষদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী করা যায়, আরও শিক্ষিত করা যায়, স্বাস্থ্যসচেতন করা যায়, এই ছিল তাঁর চিন্তা। আমার প্রশ্ন, এই বঙ্গদেশের গ্রামজীবনকে ইতিবাচক নানা সংস্কারে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কবি, সেই গ্রাম-সংস্কৃতির মধ্যে কি এমন কিছু ছিল যা শেখার মতো, ভাবার মতো?
আসন্ন শীতের মিষ্টি রোদ এ সব ভাবনার জন্য খুব উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া তখনও তো কিছুই দেখা হয়নি, সবই তো বাকি। কাজেই দুপুরের খাবার সময় ফিরে আসব এই মুচলেকা দিয়ে পথে নামি। বেশ সম্পন্ন শান্তিপ্রিয় গ্রাম। বসে থাকা অলস মোষ, চইচই হাঁস, ধানের গোলা, হাঁসেদের ঘর, প্রাইমারি ইস্কুলের উল্টো দিকের পদ্মপুকুর, ধর্মতলা এ সব পায়ে পায়ে ডিঙিয়ে যাই। রোদের আলোছায়া খেলা করে। তবে খুব বেশি টো-টো কোম্পানি করার উপায় নেই। এই কালীতলায় তিনটে থেকেই ভিড় জমতে শুরু করবে। সেই ভিড় কেবল নাগরদোলা চাপার, কালীতলা ঘিরে জমে ওঠা গ্রামের মেলা দেখার ভিড় নয়। এই গ্রাম বলির জন্য বিখ্যাত। মোষ আর ভেড়ার বিয়ে দেওয়া হবে, তার পর বলি। একটা নয়, অনেক অনেক বলি। শুনে মন ভার হয়, বিরক্তও। এত রক্ত কেন, বিসর্জন কেন, হিংসা কেন? রবীন্দ্রনাথের কথা ফের মনে জাগে।
বিকেল সন্ধের মুখে ধর্মতলায় ভিড় দেখার মতো। ঢাক বেজে ওঠে। বলির বাজনা। ঝলসে ওঠে খড়্গ। নিরীহ ছাগলেরা দাঁড়িয়ে। তাদের যাওয়ার সময় হল। সত্যি এ জগৎ মহা হত্যাশালা। প্রত্যক্ষ ভাবে বলি দেখতে ইচ্ছে করছিল না। তবে আর পাঁচটা গ্রাম থেকে যাঁরা ভিড় করে এসেছেন সেই সাধারণ মানুষগুলির মুখে কিন্তু এই বলি উপভোগের জন্য কোনও পৈশাচিক আমোদ জেগে ওঠেনি। এই বলি তাঁদের কাছে নিতান্ত রিচুয়াল, হিংসা ছড়ানোর উপায় নয়। বলির রক্ত মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ভূমির উর্বরতা এই শোণিত স্রোতে বৃদ্ধি পায় এমন কোনও প্রত্ন-বিশ্বাস তার মধ্যে মিশে থাকতেও পারে। এই গ্রামে বৃত্তি ও ধর্ম অনুযায়ী মানুষের বসবাসের পাড়াগুলি বিভক্ত। এক দিকে মুসলমানরা থাকেন। উৎসবে তাঁরাও যোগ দেন। আবার প্রান্ত ঘেঁষে থাকেন ধাঙড়েরা। বলি-দেওয়া মোষ তাঁদের প্রাপ্য। সন্ধে নামছিল। বলির জায়গা ডিঙিয়ে পায়ে পায়ে দূর মাঠের দিকে গিয়ে বসি।
বিকেল সন্ধেবেলার কালীতলার ধুলোবালি বলির রক্তে মাখামাখি। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সেখানে বাউল গানের আসর বসে। সম্পন্ন শামিয়ানা নেই, হিম আটকানোর জন্য ত্রিপল খাটানো হয়েছে। আর ধুলোর ওপর এক আঁটি করে খড় বিছিয়ে বসে পড়েছেন বাউল গানের গ্রামীণ শ্রোতারা। বিড়ির ঘন ধোঁয়া। সব মিলিয়ে আবেশময় সমাবেশ। একটা আঁটি খড় মাটিতে বিছিয়ে বসে পড়ি। কী গান গাইছেন বাউল? ও মা, এ তো দেহতত্ত্বের গান। তার আগে দুটো ধরতাই কথা বলে নিচ্ছেন। বলছেন, এই যে আপনারা বলি দিলেন, এতে কোন খোদা গড ভগবান পাবেন! পাবেন না। তাকে পেতে গেলে দেহ সাধনা করতে হবে। একটু তাজ্জব লাগে। যাঁরা বলি দিলেন তাঁরা তো এখন দিব্যি মৌজ করে এই বলি-বিরোধী কথা শুনছেন! দ্বিচারিতা? হিমমাখা কালীপুজোর রাতে নিজেই এর এক রকম উত্তর পাই। গ্রাম-বাংলার সহজ জীবনযাত্রায় নানা বিরোধী-বিবাদী ভাবনা পাশাপাশি মিলেমিশে থাকে। বলি মানে সেখানে নিতান্ত হিংসা নয়। যিনি বলি দেন, তিনি বলিবিরোধী দেহতত্ত্বের গান শুনতে আপত্তি করেন না। এই মিলমিশ আধুনিক সভ্যতায় চোখে পড়ে না। ভিন্নবাদ সেখানে বিবাদ, নানা মত সেখানে উদাস ভাবে মিলেমিশে থাকে না। তখন বাউলের গানের ওপর হিম আর হিমের ওপর বাউলের গান নেমে আসছে।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |