উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর জেলায় পরিবারের ‘সম্মানরক্ষায়’ একটি খুনের ঘটনা ঘটিয়াছে। পরিবারের অমতে ২৪ বছরের তরুণী তাঁহার প্রেমিককে বিবাহ করিয়াছিলেন। এ জন্য উভয়কেই দিল্লিতে পলায়ন করিতে হয়, সেখানে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আশ্রয়ে তাঁহারা দিনাতিপাত করিতেছিলেন। অসুস্থ মাকে দেখিতে গ্রামে ফিরিতেই তরুণীর স্বামী আবদুল হাকিম স্ত্রীর পরিজনদের হস্তে নিহত হন। তিনি যে গ্রামে যাইতেছেন, সে-কথা থানায় আগাম জানাইয়া গিয়াছিলেন, কেননা তাঁহার বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রীকে ‘অপহরণ’ করার অভিযোগ থানায় নথিভুক্ত করিয়াছিল তাঁহার শ্বশুরালয়। শুধু তাহাই নহে, তাঁহাদের তাড়া-খাওয়া জীবনের গল্পটি টেলিভিশনের বহুবিজ্ঞাপিত অনুষ্ঠান ‘সত্যমেব জয়তে’ সম্প্রচার করিয়াছিল এবং জাতীয় মহিলা কমিশন এই দম্পতির জীবনের নিরাপত্তা দিতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশকে নির্দেশও দেয়। পুলিশ যে দম্পতির প্রাণরক্ষার কোনও চেষ্টা করে নাই, তাহা স্পষ্ট। এমনও সম্ভব যে, পুলিশের কাছ হইতেই তাঁহার ফেরার খবর পাইয়া আততায়ীরা হামলা চালায়।
জাতীয় মহিলা কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদি সংগঠনগুলি যে নিছক কাগুজে সংগঠন, কোনও রাজ্য সরকারই যে ইহাদের পাত্তা দেয় না, তাহার অজস্র প্রমাণ নিত্য মেলে। উত্তরপ্রদেশের মতো অরাজক রাজ্যে পুলিশ ও সমাজবিরোধীদের পার্থক্য যেখানে এমনিতেই কম, সেখানে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার যে সরকারি আনুকূল্য পাইবে না, তাহা স্বাভাবিক। জাতিভেদপ্রথার একটি দুর্ভেদ্য নিগড় আর্যাবর্তের এই হৃদয়পুর। আবদুল হাকিম ও তাঁহার স্ত্রী উভয়েই মুসলিম, কিন্তু ধর্মান্তরিত মুসলিম। হিন্দু হইতে ধর্মান্তরিত এই মুসলিম সমাজে হিন্দু ধর্মের জাত-পাতের ভেদ ঘুচিতে চাহে না। কারণ ভারতীয় ইসলাম জাতিসাম্যের আরব্য বীক্ষা বিসর্জন দিয়া হিন্দু জাতিভেদপ্রথার সহিত আপস করিয়াই প্রসারিত হইয়াছে। অভিজাত মুসলমানের পাশাপাশি দলিত মুসলমানও এ দেশে দেখা যায় এবং অভিজাত মুসলিমদের গোরস্তানে দলিত মুসলিমদের কবরস্থ হওয়ার অধিকার মেলে না। আবদুল হাকিম এমনই অনভিজাত মুসলিম।
পরিবারের সম্মানরক্ষায় হত্যার ঐতিহ্য কোনও ধর্মীয় ঐতিহ্য নয়। হরিয়ানা, পঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশে প্রধানত সাবর্ণ হিন্দু সমাজেই এই বর্বরতা অনুশীলিত হয়। আবার পাকিস্তানে মূলত জনজাতি-অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেই ‘সম্মানরক্ষায় হত্যা’র ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত। ফলে আদতে ইহা জনজাতীয় লোকাচারেরই অন্তর্ভুক্ত, ধর্ম যাহার সহিত বোঝাপড়া করিয়া লইয়াছে। এই জনজাতীয় লোকাচার পারিবারিক সম্মান সম্পর্কে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ধারণা ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। ভারতের মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও একই প্রাবল্যে আত্তীকৃত, ইহা বিস্ময়কর নয়। অভিন্ন উপমহাদেশীয় সমাজ ও জনগোষ্ঠীই তো দুই দেশেই বাস করিতেছে। পার্থক্যের চিহ্নগুলি উপরকার, অভ্যন্তরে সেই একই অন্ধত্ব, নারীর সম্মান ও পরিবারের মর্যাদা বিষয়ে একই তমসাচ্ছন্ন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচার, যাহা পরিবারের সম্মান বাঁচাইতে মনুষ্যত্বকে অসম্মান করে। |