|
|
|
|
সমাধান খুঁজতে বৈঠকে সিব্বল |
|
ফেসবুকে মন্তব্য করে ফের আটক, কাঠগড়ায় আইনই
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
|
পুরনো বিতর্ক এখনও মেটেনি। ‘কাঠগড়ায়’ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা, যার জোরেই আইনের ফাঁসে জড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের অম্বিকেশ মহাপাত্র থেকে মহারাষ্ট্রের দুই ছাত্রী। ফেসবুক-সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে আগামিকালই বৈঠকে বসতে চলেছেন তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ মন্ত্রী কপিল সিব্বল। এর মধ্যেই বুধবার ফের ফেসবুকে মন্তব্যের জেরে আটক হলেন বছর উনিশের এক যুবক। এ বারও সেই পালঘরেই।
অভিযোগ, সুনীল বিশ্বকর্মা নামের ওই যুবক মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস)-প্রধান রাজ ঠাকরকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলেন। এর পরেই দলের সমর্থকেরা তাঁর বাড়িতে হামলা করে। তারাই সুনীলকে টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। এমএনএস সমর্থকদের অভিযোগের ভিত্তিতে আটক করা হয় সুনীলকে। এ দিন বেশ সতর্ক ভাবেই পা ফেলেছে পালঘর পুলিশ। সুনীল সত্যিই ফেসবুকে কোনও “অপমানজনক” মন্তব্য করেছেন কি না, খতিয়ে না দেখে এখনই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে না পুলিশ। কারণ বাল ঠাকরের মৃত্যুতে মুম্বই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে মন্তব্য করে এই পালঘরেরই দুই তরুণী গ্রেফতার হন। এই ঘটনায় সাসপেন্ড করা হয় দুই পুলিশকর্মীকে। তার জেরে আবার আজই সেখানে বন্ধ পালন করেছে শিব সেনা।
কেন এমন বার বার হচ্ছে? ফেসবুকে ছবি পোস্ট, কিংবা কার্টুন বা মন্তব্যে ‘লাইক’ কতটা নিরাপদ?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বার ৬৬এ ধারাটা দেখে নেবেন।
যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র থেকে মহারাষ্ট্রের ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী অসীম ত্রিবেদী, মহারাষ্ট্রের কলেজছাত্রী শাহিন ধাদা ও রেণু শ্রীনিবাস থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার দুই কর্মী--মিল একটাই। ফেসবুক বা ই- মেলে রাজনীতিকদের নিয়ে ‘রসিকতা’ করার জেরে এঁদের সকলকেই হাজতবাস করতে হয়েছে। আর সকলের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা। দেশ জুড়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলি অভিযোগ তুলেছে, বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে কাজে লাগানো হচ্ছে। বাক্-স্বাধীনতায় শিকল পড়ানো হচ্ছে। মন্ত্রী কপিল সিব্বল বলছেন, পুলিশ আইনের অপপ্রয়োগ করছে। সাইবার আইন বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলছেন, আসলে সর্ষের মধ্যেই ব্রহ্মদৈত্য! সমস্যার মূলে তথ্য প্রযুক্তি আইনের এই ৬৬এ ধারা। অভিযোগ উঠেছে, এই ধারায় আইনের পরিভাষা এতটাই অস্পষ্ট যে ইচ্ছে করলেই কাউকে হাতকড়া পরানো যায়।
এই পরিস্থিতিতে আইনের সংশোধন করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সিব্বল জানান, তিনি আইন-সংশোধন করতে রাজি। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি ক্রমবর্ধমান সাইবার-অপরাধের ধুয়ো তুলে আইনের ফাঁস আলগা করার বিরুদ্ধে। সমাধান খুঁজতে আগামিকাল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের শীর্ষকর্তাদের বৈঠকে ডেকেছেন সিব্বল।
কী ভাবে ফেসবুক থেকে শুরু করে গোটা ওয়েব-দুনিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন?
সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ অপার গুপ্ত বলেন, “মূল সমস্যা হল আইনের ভাষা নিয়ে। বলা হয়েছে, ইন্টারনেটে অশোভন, বিপজ্জনক, বিরক্তিকর, অসুবিধাজনক বা অপমানজনক মন্তব্য বা বার্তা পাঠানোটা অপরাধ। কিন্তু কোনটা কার কাছে বিরক্তিকর, কোনটাই বা অসুবিধাজনক, তার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। সেই কারণেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, অসীম ত্রিবেদীর ক্ষেত্রে এই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটেছে।” তাঁর বক্তব্য, আইনে গলদ থাকার ফলেই ফেসবুকে ‘নির্বিষ’ মন্তব্যের জন্য ২১ বছরের শাহিনকে গ্রেফতার করতে পেরেছে পুলিশ।
প্রাথমিক ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে রাজ্য পুলিশকে সচেতন করতে বিস্তারিত নির্দেশিকা জারি করা হবে। কাউকে গ্রেফতার করার আগে, আইজি-পদমর্যাদার পুলিশ অফিসারের অনুমতি নেওয়ার কথাও বলা হবে। সিব্বল জানিয়েছেন, প্রয়োজনে আইনের সংশোধন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেও তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা আবার তাতে আপত্তি তুলেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “সব দিকই দেখা প্রয়োজন। ভুললে চলবে না, এই ফেসবুক-ইন্টারনেটের মাধ্যমেই কিছু দিন আগে কর্মসূত্রে দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল। একই ভাবে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বাধানোরও চেষ্টা চলছে। কাজেই আইন না বদলে তার অপপ্রয়োগের বিষয়ে সতর্ক হলেই চলবে।” অন্য দিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতো বাক্-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আইনজীবীদের মত, আইনের সংশোধনই একমাত্র সমাধান। নইলে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তৈরি ‘সোনার কেল্লা’-র মতো ব্যঙ্গচিত্রের জন্য অনেকেই বিপদে পড়বেন। তাঁদের দাবি, পুরো ৬৬এ ধারাটাই ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া হোক।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন তৈরি হয়েছে ২০০০ সালে। তা হলে এত দিন পরে কেন এই আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, শুরুর দিকে ওই আইনে ৬৬এ ধারার কোনও নামগন্ধ ছিল না। প্রথম ইউপিএ-সরকারের জমানার একেবারে শেষ লগ্নে, ২০০৮ সালে আইন সংশোধনের সময় এর আবির্ভাব। ওই বছর ২৩ ডিসেম্বর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে সাত মিনিটে সাতটি বিল পাশ করায় সরকার। যার অন্যতম এই তথ্য প্রযুক্তি আইনের সংশোধনী। ফলে এ নিয়ে সংসদে কোনও বিতর্কই হয়নি। সিপিএমের পলিটব্যুরো নেত্রী বৃন্দা কারাট বলেন, “সংসদে বিল পেশের সময়ই আমরা বিরোধিতা করে বলেছিলাম, এই আইনের অপপ্রয়োগ হবে। পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্রের সরকার আমাদের আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণ করে দিল।” |
|
|
|
|
|