চিনে নতুন প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং নির্বাচিত হওয়ার পর গোটা বিশ্বের দরবারে একটি নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে বেজিং। সেটি হল, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি তাঁরা সমান ভাবে উদ্যোগী ‘রাজনৈতিক সংস্কারের’ জন্যও।
চিনের একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনতন্ত্রে রাজনৈতিক সংস্কার কি সোনার পাথরবাটি নয়? বেজিং বলছে, আদৌ নয়। আর কেন নয়, তার ব্যাখ্যা দিতে লি জুন রু (চিনের কমিউনিস্ট পার্টির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য) একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন প্রতিবেশী দেশগুলিতে। সদ্যসমাপ্ত অষ্টাদশ পার্টি কংগ্রেসের বার্তা পৌঁছতে গিয়ে তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘কিছু ভুল রয়ে গিয়েছে’ পার্টিতন্ত্রে। নতুন প্রেসিডেন্টের জমানায় তা শুধরানোর চেষ্টা হচ্ছে।
গত দু’দিন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক সেরে আজ রাতে শ্রীলঙ্কা পাড়ি দিল চিনের প্রতিনিধি দল। আজ নয়াদিল্লির চিনা দূতাবাসে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক পথে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দিলেন লি জুন রু। উন্নয়নের নামে যাতে কোনও অনিচ্ছুক মানুষের জমি না নেওয়া হয়, তার জন্য ‘মেকানিজম’ তৈরি হচ্ছে। তাঁর কথায়, “অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক সংস্কার না করা হয়, তা হলে তা স্থায়ী হয় না। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ইতিমধ্যেই অনেক কিছু বদলেছি আমরা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের অবসরের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাত বদল হওয়ার পদ্ধতিটা মসৃণ হয়েছে।” চিনের কমিউনিস্ট নেতার বক্তব্য, “আমাদের রাজনৈতিক কাঠামোর যেমন অনেক অর্ন্তনিহিত শক্তি রয়েছে, তেমন কিছু দুর্বলতাও রয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর বড় বেশি নির্ভরশীলতা রয়েছে চিনে।” তাই বিকেন্দ্রিকরণের জন্য তাদের প্রায় ষাট বছরের পুরনো ‘পলিটিকাল কনসাল্টেশন কনফারেন্স’ বা পিসিসি-র ধারণাকে নতুন করে সামনে আনতে চলেছেন নতুন নেতৃত্ব। জানানো হচ্ছে, দেশের সব রাজনৈতিক আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই পিসিসি-কে সামিল করা হবে। মোট ৩৪টি বিভাগ থাকবে এই পিসিসি-র। তাৎপযপূর্ণ ভাবে এই পিসিসি-র মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে কমিউনিস্ট পার্টির। বাকি ৬০ শতাংশ বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থা, বেসরকারি গোষ্ঠী এবং সমাজের নানা অংশের মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসবেন।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, দীর্ঘদিন একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন চলতে থাকায় পার্টির মধ্যে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, উন্নয়নের ধুয়ো তুলে দমননীতির অভিযোগে জেরবার নেতৃত্ব। শীর্ষ নেতাদের আত্মীয়দের আর্থিক সমৃদ্ধির অভিযোগেও উত্তাল চিনের সাধারণ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন ফেসবুকে। আর তাই এক দিকে দেশের ভিতরে জনতার ক্ষোভ প্রশমিত করতে এবং বিদেশের কাছে নিজেদের সংস্কারপন্থী ভাবমূর্তি তুলে ধরতে রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে।
রাজীব গাঁধীর ঐতিহাসিক চিন সফরের সময় চিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কূটনৈতিক কর্তা রণেন সেন জানালেন, “হু জিন তাওয়ের সময় থেকেই পার্টির ভিতরে রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। যত দিন যাবে, তা আরও বাড়বে। চিনের মধ্যে বহু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস হয়ে গিয়েছে। আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রশ্নেও কিছু কিছু অঞ্চল অনেক এগিয়ে গিয়েছে, পিছনে পড়ে রয়েছে অনেক এলাকা। তৈরি রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ক্ষোভ। তবে মুখে বললেও এই নিয়ে শেষ পর্যন্ত কতদূর পদক্ষেপ করবেন চিনের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।” জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন বিভাগের অধ্যাপক শ্রীকান্ত কোন্দাপল্লী অবশ্য মনে করছেন “পুরোটাই কথার কথা। রাজনৈতিক সংস্কারের নামে কিছু ‘কসমেটিক’ সংস্কার হচ্ছে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। পরিবর্তনশীল এবং বিরাট বাজার রয়েছে, এমন বিভিন্ন দেশে কম দামে পণ্য রফতানি করে বাজার করায়ত্ত করার এ এক চৈনিক কৌশলমাত্র। চিনের কমিউনিস্ট শাসকেরা কখনও সাধারণ মানুষ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অথবা অন্য দলের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা ক্ষমতা ভাগ করে নেবেন না।” কিন্তু চিনের ‘পলিটিক্যাল কনসাল্টেশন কনফারেন্স’-এ তো ৬০ শতাংশ থাকবে কমিউনিস্ট পার্টির বাইরের প্রতিনিধিত্ব? কোন্দাপল্লীর কথায়, “এই পিসিসি হল অনেকটা আমাদের দেশের রাজ্যসভার মতো। প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতার থেকে দূরেই থাকবে এই কমিটি।” |