নিমহ্যান্সের সমীক্ষা বাড়ছে মানসিক রোগীর
সংখ্যা, অব্যবস্থা চিকিৎসায়
মলেশ মিত্র। বয়স ২৭ বছর। ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল খেলায় এলাকায় খুব নামডাক ছিল। কিন্তু চাকরির প্রতিযোগিতায় খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারছিলেন না। বছর চারেক সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেন। বেরোতেনও না। মনে হত, কেউ তাঁর উপর নজর রাখছে। এ ভাবে চলার পরে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন তিনি।
বছর পঞ্চাশের প্রশান্ত সরকারের বিষয়টা একটু আলাদা। গত ১২-১৩ বছর ধরে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগছেন। কোনও কারণ ছাড়াই তাঁর সব সময় মনের মধ্যে একটা ভয় ভয় ভাব। রাস্তাঘাটে চলাফেরা করেন মানসিক অস্বস্তি নিয়ে।
৩৬ বছরের মিতা চক্রবর্তী থাকেন দক্ষিণ কলকাতার একটি বহুতলে। চাকরি করেন বহুজাতিক সংস্থায়। স্কিৎজোফ্রেনিয়া’র রোগী মিতাদেবী নিয়মিত ওষুধ খান। তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে তিনি মারমুখী হয়ে ওঠেন। ফলে, ঘরে-বাইরে সমস্যা তৈরি হয়। চাকরি রাখাটাই এখন তাঁর দায় হয়ে উঠেছে। কমলেশ, প্রশান্তবাবু বা মিতাদেবীর ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সাত কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের শিকার। এর মধ্যে প্রায় দু’কোটি মানুষের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। যে হারে মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সালে এ দেশে নিঃশব্দে তা মহামারীর আকার নেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সারা বিশ্বে ২০২৫ সালের মধ্যে হৃদ্রোগকেও পিছনে ফেলবে মানসিক রোগ।
বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড সায়েন্স বা নিমহ্যান্সের সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশের ৩৫ লক্ষ মানসিক রোগীর হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা দরকার। কিন্তু দেশে মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতাল বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৪০। এই ৪০টি প্রতিষ্ঠানে মাত্র ২৬ হাজার শয্যা রয়েছে বলে ওই সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করা হয়, তার সিংহ ভাগই মান্ধাতা আমলের। মানসিক হাসপাতালগুলির সীমানা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, এগুলির আধুনিকীকরণে কেউ উদ্যোগী হয়নি বলেও জানানো হয়।
যথেষ্ট সংখ্যক মানসিক চিকিৎসকের অভাবে রোগীদের অনেককেই সাধারণ চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এতে আশঙ্কা থেকে যায় হিতে বিপরীত হওয়ার। নিমহ্যান্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশে এই মুহূর্তে ১২ হাজার মানসিক চিকিৎসকের প্রয়োজন। কিন্তু রয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন হাজার।
কেন মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে? নিমহ্যান্সের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া এবং নগরায়নের ফলে মানুষের মনের উপর চাপও বাড়ছে। এই চাপ যাঁরা সহ্য করতে পারছেন না, তাঁরাই নানা রকম মানসিক রোগের শিকার হচ্ছেন। কলকাতার মনোরোগ চিকিৎসক অমিতাভ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এখন তো বলা হচ্ছে সারা বিশ্বে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে এক জনের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন। মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বার্ধক্যজনিত কারণেও নানা ধরনের মানসিক রোগ বাড়ছে। পরিবার ক্রমশ ছোট হতে থাকায় শিশুরাও অবসাদের শিকার হচ্ছে।” মানসিক রোগের পিছনে কোনও একটি কারণ নয়, একাধিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক শ্রীমন্তী চৌধুূরী। সারা বিশ্বেই মানসিক রোগীদের সিংহ ভাগই শহরে থাকেন বলে তিনি জানিয়েছেন। শ্রীমন্তীদেবীর কথায়, “যে কোনও কারণেই হোক, গ্রাম থেকেও মানসিক রোগীদের শহরে আসার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনেক মানসিক রোগী আবার মাদকাসক্তির জন্য শহরে থাকতে চায়। তাই, স্বাভাবিক ভাবেই শহরে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশি।”
যদি কেউ একান্নবর্তী পরিবারে বাস করেন তাঁর মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করেন বিশিষ্ট মনোবিশ্লেষক দিনাজ বিলিমোরিয়া। একাকীত্ব ও সমাজে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকার ফলে অনেকেরই মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। শহরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির প্রধান দু’টি কারণ হল, বাবা-মায়ের যতটা সময় তাদের সঙ্গে কাটানো উচিত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা তা করেন না। তা ছাড়া, স্কুলে যে পড়ার বোঝা, অনেকেই তা বইতে পারে না বলে মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “ছোট ছোট পরিবারে মানসিক চাপ কমানোর জন্য যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা পাওয়া যায় না। সেখান থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। প্রথম অবস্থায় আমাদের কাছে এলে এই ধরনের বেশির ভাগ রোগীকেই সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেক পরে আসেন রোগীরা।” শহরের পাশাপাশি গ্রামেও মানসিক রোগ আগের চেয়ে বাড়ছে কেন? দিনাজ বলেন, “গ্রামে যে আগের তুলনায় খুব একটা বেড়েছে তা নয়। এখন মানুষের মধ্যে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই, তাঁরা রোগীকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। আগে যা করতেন না।” লোপামুদ্রা গোস্বামীর মতে, ভারতের মতো দেশে দ্রুত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন মনোরোগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাঁর কথায়, “বাজার-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দরুণ সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই কারণে নানা রকম মানসিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.