দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
গত দেড় বছরে জেলা সফরে গিয়ে যে সব প্রকল্প ঘোষণা বা শিলান্যাস করেছেন, সেগুলি কী অবস্থায় আছে, তার একটা স্পষ্ট ছবি পেতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র সম্প্রতি সমস্ত দফতরের সচিবদের চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কবে, কোথায়, কোন প্রকল্প ঘোষণা কিংবা শিলান্যাস করেছিলেন, তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। সবিস্তার জানাতে বলেছেন ওই সব প্রকল্পের বর্তমান পরিস্থিতি। ইতিমধ্যে ওই তালিকা ধরে ই-মেল মারফত রিপোর্ট জমা পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে।
কেন এই উদ্যোগ? রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, ক’মাস পরেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার পরে বছর না ঘুরতেই লোকসভা ভোট। মূলত সে দিকে তাকিয়েই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্পগুলির হাল যাচাই করে নিতে চাইছে রাজ্য সরকার। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীও প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে সমস্ত প্রকল্প দ্রুত শেষ করার কথা বলছেন। কোথাও সমস্যা হলে সে কথাও অকপটে জানাতে বলেছেন তিনি।”
কী সেই সমস্যা? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “জমি-নীতি চূড়ান্ত না হওয়ায় অধিগ্রহণে সংশয় তৈরি হচ্ছে। ওই সমস্যা এড়াতে বিভিন্ন দফতরের হাতে থাকা জমিতেই অধিকাংশ প্রকল্প গড়ে তুলতে চাইছে সরকার। কিন্তু তাতেও জট কাটছে না।” উদাহরণ হিসেবে ওই কর্তা বলেন, কোথাও পূর্ত দফতরের জমিতে আইটিআই তৈরি হবে, কোথাও কৃষি দফতরের খামারবাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দফতরগুলির মধ্যে জমি হস্তান্তরে দেরি হচ্ছে। সম্প্রতি টাউন হলের বৈঠকে এ নিয়ে অফিসারদের সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
তবে, সব প্রকল্পই যে সরকারি হেফাজতে থাকা জমিতে তৈরি হবে, তা-ও নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে জমি নিতে হবে। আর সমস্যা সেখানেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “ডায়মন্ড হারবারের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, বারুইপুর, মগরাহাট ও পাথরপ্রতিমায় আইটিআই হবে। ওই সব এলাকায় কিছু জমি সরকারের হাতে থাকলেও আরও জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কাজ থমকে আছে সেখানেই।” একই ভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামে স্টেডিয়াম তৈরির কাজও আটকে রয়েছে জমি-জটে।
কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে অর্থসঙ্কট। রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, নতুন সরকারে রাজস্ব আদায় বাড়লেও কমানো যায়নি পরিকল্পনা বর্হিভূত খরচ। প্রতি মাসেই আয়-ব্যয়ের ব্যবধান লাফিয়ে বাড়ছে। চলতি আর্থিক বছরে ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ৩২২ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হয়ে গিয়েছে। আর তাতেই শঙ্কিত রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা অতিথি আপ্যায়নে যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে, তাতে উন্নয়নের বরাদ্দই কাটছাঁট হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন দফতরকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মোট বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ টাকা খরচের আগাম অনুমতি দেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশের বেশি টাকা হাতে পায়নি তারা।
এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্পগুলি কী ভাবে দ্রুত শুরু করা যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন দফতরের সচিবদের ডেকে দফায় দফায় বৈঠক করছেন মুখ্যসচিব। মহাকরণ সূত্রের খবর, পূর্ত, সেচ, নগরোন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি, স্বাস্থ্য এবং কারিগরি শিক্ষা দফতরের হাতে গড়ে ১৫-১৬টি প্রকল্প রয়েছে। গত দেড় বছরে নানা সময়ে জেলা সফরে গিয়ে সেগুলি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর প্রকল্প ঘোষণার শেষ নেই। কিন্তু আর্থিক টানাটানির কারণে অর্থ দফতর টাকা না-ছাড়ায় বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা। তাই এক রকম চাপ সৃষ্টি করতেই সংশ্লিষ্ট নথিতে ‘মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্প’ লিখে অর্থ দফতরে ফাইল পাঠাচ্ছেন সচিবদের একাংশ।”
কিন্তু তাতেও কতটা চিড়ে ভিজবে তা নিয়ে সংশয়ে সচিবেরাই। রাজ্য প্রশাসনের একাধিক আধিকারিক বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় এমন বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে যেগুলির অধিকাংশ টাকা কেন্দ্র দেবে। সেই খাতে যোজনা কমিশনের পাঠানো প্রথম দফার টাকা ক’মাস আগে মহাকরণে চলে এলেও তার পুরোটা এখনও হাতে পায়নি অনেক দফতর।” যেমন, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীন ব্যাকওয়ার্ড রিজিওন গ্র্যান্ট ফান্ডের (বিআরজিএফ) টাকায় জঙ্গলমহলে একাধিক কলেজ, আইটিআই ও স্টেডিয়াম তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিল রাজ্য। তার অধিকাংশই তৈরি করবে পূর্ত দফতর। কিন্তু প্রয়োজনমতো টাকা না পাওয়ায় বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ ধীর গতিতে চলছে বলে ওই দফতরের একাধিক ইঞ্জিনিয়ার জানিয়েছেন।
বিআরজিএফ-এর পুরো টাকা হাতে পায়নি জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি (পিএইচই) দফতরও। প্রতি মাসেই বরাদ্দের টাকা চেয়ে বিভিন্ন দফতরের সচিবেরা চিঠি পাঠাচ্ছে অর্থ দফতরে। অর্থ দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, চলতি অর্থবর্ষে অনুমোদিত প্রকল্পের ১৬৬ কোটি টাকা এখনও হাতে পায়নি পূর্ত দফতর। জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরেরও পাওনা ১৪৫ কোটি টাকার মতো। অনুদানের টাকাই শুধু নয়, গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন খাতে (আরআইডিএফ) নাবার্ড থেকে যে ঋণ নেয় রাজ্য সরকার, অনেক দফতর সেই টাকাও পুরোপুরি পায়নি বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
অর্থাভাবে কী ভাবে আটকে আছে ছোটখাটো কাজও?
নতুন সরকারের এক বছরের মাথায় ‘প্রত্যাশা থেকে প্রাপ্তি’ শীর্ষক পুস্তিকায় বলা হয়েছিল, জেলা হাসপাতালগুলিতে গরিব রোগীর আত্মীয়দের থাকার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে আবাসন দফতর। কিন্তু জেলা তো দূরের কথা, কলকাতার মাত্র একটি হাসপাতালে রাতের আশ্রয় তৈরির কাজে সবে হাত দিয়েছে তারা। টাকার সংস্থান না-হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করা সত্ত্বেও রাজ্যের সব ব্লকে (৩৪১টি) কিষাণ বাজার তৈরি থেকে পিছিয়ে এসেছে কৃষি বিপণন দফতর। ঝাড়গ্রাম, বিষ্ণুপুর, আলিপুরদুয়ার ও পুরুলিয়ায় গ্রামীণ হাটের আয়োজন করার কথা বললেও জমি-ই চিহ্নিত করে উঠতে পারেনি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর।
ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্যের সমস্ত মহকুমায় (৬৫টি) একটি করে মহিলা থানা হবে। প্রথম দফায় ২০টি এমন থানা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু আর্থিক টানাটানির কারণে ১০টি থানা তৈরি করেই থমকে গিয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতর। ওই দফতরের এক কর্তা বলেন, “হলদিয়ায় কমিশনারেট তৈরির যাবতীয় প্রকল্প রিপোর্ট মাস সাতেক আগে জমা পড়েছে অর্থ দফতরে। এখনও সেখানেই পড়ে রয়েছে ওই ফাইল।” |