শনিবারের নিবন্ধ
ফোঁস করতে দোষ কী
ভারতীয় ক্রিকেট ড্রেসিংরুমে একটা গল্প চালু আছে। মনোজ তিওয়ারির ‘ফার্স্ট ইয়ার’ নাকি আর শেষ হচ্ছে না। মানে, ফার্স্ট ইয়ারে যেমন র‌্যাগিংয়ের সামনে পড়তে হয় মনোজকে সেটা আগেও পড়তে হয়েছে, আবার এত দিন পর নিজেকে প্রমাণ করেও পড়তে হচ্ছে। পুজোর পরের এই সময়টায় অনেক ছাত্রছাত্রীই ‘মনোজ সিনড্রোম’-এ ভুগছেন!
জুলাই-অগস্ট মাসে র‌্যাগিং নিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছেন। এই নভেম্বর-ডিসেম্বরেও তার ভূত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারটা দুঃসহ মেগা সিরিয়ালের মতো লাগছে। ফুরোচ্ছে আর না। এখনও মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিদদের চেম্বারে ভিড় করে আসছে আঠারো-কুড়ি বছরের মুখগুলো। ধ্বস্ত, আতঙ্কিত, উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা। ছুটির পর যাদের কলেজ বা হস্টেলে যেতে ভয় করছে।
দক্ষিণ কলকাতার নামী কলেজে ভর্তি হয়েছে জলপাইগুড়ির মেয়েটা। সেই কলেজের হস্টেল র‌্যাগিং-এর জন্য ‘কুখ্যাত।’ মেয়েটি বলে, “ফিতে দিয়ে স্তুনের দৈর্ঘ্য মেপে চার্ট তৈরি করে সিনিয়ারেরা। উলঙ্গ অবস্থায় ফ্যাশন প্যারেড করানো হয়, ইন্টারকোর্সের অভিনয় করে দেখাতে হয়। জাস্ট নিতে পারছি না।’’ কলকাতার এক নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র বলছিল, “আগে কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো হত, নিজের ফুলশয্যার রাতে কী করা হবে তার ডেমো দিতে বলা হত। এখন ‘ছত্রাক’ (পাওলি-খ্যাত)-এর এমএমএস দেখে রানিং কমেন্ট্রি দিতে বলে।’’
‘থ্রি ইডিয়েটস’ সিনেমায় র‌্যাগিংয়ের একটি দৃশ্য।
অভিজ্ঞরা কিন্তু একটু ভেবে দেখতে পরামর্শ দিচ্ছেন। বকুনির চোটে খেলা ছেড়ে কেমিস্ট্রি পড়তে বাধ্য হওয়া সেটা এক ধরনের র‌্যাগিং নয়? সবচেয়ে বড় বন্ধু ছোটমামা কথা নেই বার্তা নেই, ফট করে মরে গেল র‌্যাগিং নয়? চুমু-টুমু খাওয়ার পর প্রেমিকা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এনআরআই বিয়ে করল র‌্যাগিং নয়? সারা জীবন নাচ শিখে বিয়ের পর শাশুড়ির ফতোয়ায় নাচ বন্ধ হয়ে গেল র‌্যাগিং নয়? জীবন তো উঠতে-বসতে র‌্যাগিং চালাচ্ছে, তা হলে আলাদা করে কয়েক মাসের র‌্যাগিংকে এতটা হৃদয়ে নিয়ে ফেলার দরকারটা কী? বরং দরকার হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সার্ভাইভ করা।
বেঁচে থাকুক আমাদের হিন্দি সিনেমা। ‘থ্রি ইডিয়েটস’-এর রেঞ্চোই মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে ‘আল ইজ ওয়েল’, ‘আল ইজ ওয়েল’, ‘আল ইজ ওয়েল!’ জাতকের গল্পের ঋষিও তো সাপকে বলেছিলেন, “অকারণে কামড়াতে বারণ করেছি। কেউ মারতে এলে ফোঁস করতে তো বারণ করিনি।” অতএব, বুদ্ধি করে ফোঁস করতেও জানতে হবে।
অনন্ত আস্থানার ‘ফোঁস করা’র গল্প বলি। গল্প নয়, সত্যি। ২০০৪-এ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। হস্টেলে ঢোকার পরেই দেখেন, জুলাই-অগস্ট টানা দু’মাস শনিবারের রাত মানেই হস্টেলে ‘সিনিয়রিটি শো।’ জামা-প্যান্ট খুলে নীচের লনে ফার্স্ট ইয়ারের ‘ধুররা’দের (এই নামেই ডাকত সিনিয়ারেরা। ধুররা মানে গাধা) দাঁড় করানো হয়। তার পর কারও পায়ুতে সিগারেট গুঁজে দেওয়া হয়, কাউকে আবার আন্ডারপ্যান্ট খুলে ছিপিখোলা সরুমুখ বোতলের উপর বসে থাকতে বাধ্য করা হয়। ভয়ের চোটে শনিবার সন্ধে থেকেই অনেক জুনিয়ার আশপাশের মাঠে-পার্কে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকত। অনন্ত সরাসরি সিনিয়ারদের সঙ্গে কোনও ঝামেলায় যাননি, মারামারি করেননি।

র‌্যাগিংয়ের শাস্তি
প্রতিষ্ঠান থেকে বার করে দেওয়া এবং ওই সেশনে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে যাতে ভর্তি না হতে পারে তা নিশ্চিত করা।
অ্যাডমিশন বাতিল হতে পারে।
সাসপেন্ড করা হতে পারে।
১-৪ সেমিস্টার পর্যন্ত পরীক্ষায় বসতে দেওয়া আটকানো হতে পারে।
স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ বাতিল হতে পারে।
রেজাল্ট আটকে যেতে পারে।
হস্টেল থেকে বিতাড়িত হতে পারে।
২৫ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।

শুধু নিঃশব্দে জুনিয়ারদের একজোট করে একটা প্রতিরোধ তৈরি করেছিলেন। তার পর স্থানীয় ধর্মীয় সংগঠনের কাছে দরবার করে আলিগড়ের র‌্যাগিং উপর সেই সংগঠনের ফতোয়া বসিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ব্যাস, র‌্যাগিং বন্ধ। কিংবা সচিন সোনির কথাই ধরা যাক। জুনিয়ার, শিক্ষক আর সিনিয়ারদের একাংশকে একজোট করে ২০০৪-০৫ সালে যিনি পুণে-র সিম্বায়োসিস ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট থেকে র‌্যাগিং-কে পুরোপুরি বিদেয় করেছিলেন।
তবে, আইন-কানুন-প্রচার সত্ত্বেওর‌্যাগিংকে ইরেজার দিয়ে একেবারে মুছে ফেলা যায়নি। মনস্তত্ত্ববিদ হিরণ্ময় সাহা যার ব্যাখ্যায় বলেছেন আমার সামনে কেউ ঘাড় নোয়াচ্ছে, কথা শুনছে এই ‘সেন্স অফ পাওয়ার’টা খুব আরামের। এর মধ্যে একটা ‘স্যাডিস্টিক প্লেজার’ও কাজ করে। আইন করে বা কমিটি গড়ে একে এককথায় মোছা যাবে না। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল তাই বলেছেন, একটু ট্যাক্টফুলি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনের স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে হবে। ‘আমি অপমানিত হচ্ছি,’ বা ‘আমার ইগো ধাক্কা খাচ্ছে,’ এতটা ভেবে ফেলা উচিত নয়। নিজেকে বোঝাতে হবে, এটা কয়েক দিনের মাত্র ব্যাপার। তবে ব্যাপারটা যদি মারধর, যৌন অত্যাচার পর্যায়ে পৌঁছোয় তা হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটি বা অ্যান্টি র‌্যাগিং স্কোয়াডকে বলতে হবে। বাবা-মা-আত্মীয়দের জানাতে হবে। সাহায্যের জন্য অ্যান্টি র‌্যাগিং হেল্পলাইন (১৮০০১৮০৫৫২২) আছে। আছে সর্বভারতীয় স্তরে র‌্যাগিংবিরোধী আন্দোলনে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন (যেমন ‘কিওর’ বা ‘সেভ’)। রেগিংয়ের কাছে হেরে না-গিয়ে জীবনে জিতে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চার পাশে। আইআইটি খড়্গপুরে অসিত চক্রবর্তীর গল্প এখনও ছাত্রদের মুখে-মুখে ঘোরে। ৩৯ বছর পরেও সেখানে তিনি ‘বাঘ অসিত’ নামে পরিচিত। এখন কল্যাণী মোহনপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৭৩ সালে খড়্গপুর আইআইটিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময় খড়্গপুরে যখন-তখন জুনিয়ারদের জামা-কাপড় খুলিয়ে র‌্যাগিং হত। এক আদিবাসী ছাত্রকে র‌্যাগিংয়ের সময় সিনিয়ারেরা প্রচণ্ড মারধর করায় সেই স্বাস্থ্যবান ছাত্রটিও সিনিয়ারদের বেধড়ক পেটায় আর তার সমর্থনে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের নিয়ে র‌্যাগিং-বিরোধী ফৌজ তৈরি করে ফেলেন অসিত। আইআইটি-র আশপাশের আদিবাসী গ্রাম থেকে দলে দলে ছেলে এসে সেই দলে যোগ দিয়েছিল। আর যায় কোথায়, সিনিয়ারদের র‌্যাগিং মাথায় উঠল।

ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের রেগুলেশন
কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বুকলেট এবং ব্রাউচার-এ র‌্যাগিং সংক্রান্ত রেগুলেশন ছাপা থাকবে।
অ্যান্টি র‌্যাগিং কমিটি ও স্কোয়াডের টেলিফোন নম্বরও ছাপা থাকবে ওই হেল্পলাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে।
ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সঙ্গে অ্যান্টি র‌্যাগিং স্কোয়াড নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।
তাদের যে কোনও অভিযোগ গোপন রাখতে হবে।
হস্টেলে গোপন অভিযান চালাতে হবে।
ভর্তির সময় প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে মুচলেকা দিয়ে জানাতে হবে যে তারা র‌্যাগিংয়ে জড়িত থাকবে না বা মদত দেবে না। দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
কলেজের সর্বত্র র‌্যাগিং বিরোধী পোস্টার থাকবে।
ভাইস চ্যান্সেলারকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর র‌্যাগিং সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
ছাত্রদের মানসিক কাউন্সেলিং-এর জন্য কাউন্সেলার থাকবেন।

সুজিত সরাফের আবার অন্য গল্প। দিল্লি আইআইটি-র ছাত্র। সালটা ১৯৮৭। একটা ইন্টারভিউয়ে সুজিত বলেছিলেন “প্রথম দিন হস্টেলে ঢুকতেই সিনিয়ারেরা হাঁটু গেড়ে বসতে বলল। আমাদের গলায় কুকুরের বকলেস পরানো হল আর মুখে ঘেউঘেউ আওয়াজ করে গোটা ক্যাম্পাস ঘুরতে বলা হল। সেই শুরু। প্যান্ট খুলিয়ে পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্য মাপত সিনিয়ারেরা। এক-জন অন্য জনের পুরুষাঙ্গ ধরে ট্রেনের মতো দৌড়তে হত আর মুখে ট্রেনের হুইসেলের মতো শব্দ করতে হত।” ভেবেছিলেন পালিয়ে যাবেন। ইঞ্জিনিয়ার-টিঞ্জিনিয়ার হওয়া ভেসে যাক। কিন্তু টিকে গেলেন। আপাতত মহাকাশ বিজ্ঞানী। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন। একাধিক গল্পের বই, নাটক লিখেছেন। দুর্দান্ত কেরিয়ারগ্রাফ। র‌্যাগিং তাঁর জীবনের গতি মাঝপথে আটকে দিতে পারেনি।
রয়েছেন আমাদের অমিতাভ বচ্চন, যিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “মারাত্মক অভিজ্ঞতা আমার। আমি সত্যিই আপনাকে বলতে পারব না কতটা ভয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। প্লিজ এর থেকে বেশি আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।” তবু সেই র‌্যাগিংয়ের সময় পেরিয়েই তিনি ‘অমিতাভ বচ্চন’ হয়েছেন। অতএব হাল ছেড়ো না বন্ধু। কবীর সুমন তো সেই কবেই লিখেছেন, “দেখা হবে তোমায়-আমায় অন্য গানের ভোরে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.