|
|
|
|
ফেরার পথ বন্ধ, ভিন্ রাজ্যে কাজের খোঁজে বাগদা চাষি |
সুব্রত গুহ • কাঁথি |
একই জমিতে তিন গুণ লাভের আশায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী ও পার্শ্বস্থ এলাকায় এখন বাগদা
চাষের রমরমা। সরকারি বিধিনিষেধ না-মেনেই কৃষিজমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে চলছে বাগদা চাষ। ফলে একদিকে
যেমন কৃষিজমি কমছে, তেমনই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় লোকসানে পড়ে সর্বস্বান্ত
হচ্ছেন বাগদা চাষি।
এই দুই চিত্র নিয়েই প্রতিবেদন আনন্দবাজারের। আজ প্রথম কিস্তি। |
এ কূল-ও কূল দু’কূলই হারিয়েছেন গৌতম, উত্তম। কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের কাজলা গ্রামের ভুঁইয়া পরিবারের এই দুই ভাই চাষজমিকে পুকুর বানিয়ে মহা উৎসাহে শুরু করেছিলেন বাগদার ব্যবসা। দাম ঠিকমতো না পাওয়ায় চরম লোকসানে পড়তে হয়েছে তাঁদের। জমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে ফেলায় চাষবাসে যে ফিরে যাবেন, এমন উপায় নেই। অগত্যা ভিন্ রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেই মহাজনের ঋণশোধের কথা ভাবছেন তাঁরা। শুধু গৌতম-উত্তমই নন, বাগদা চাষ করে মাথায় হাত পড়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আরও অনেকেরই। উদাসীন প্রশাসন।
পূর্ব মেদিনীপুরের মূলত উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায় ৫০০০ হেক্টর জমিতে বাগদা চাষ হয়। জেলার ২৫টি ব্লকের মধ্যে হলদি ও রসুলপুর নদীর তীরে কাঁথি ৩, দেশপ্রাণ, খেজুরি ১ ও ২, নন্দকুমার, চণ্ডীপুর ও ভগবানপুর ২ ব্লকে চাষযোগ্য জমিকে ভেড়িতে পরিণত করার হারটা বেশি। কাঁথি মহকুমা কৃষি আধিকারিক পরেশ বেরা জানিয়েছেন, শুধু এই মহকুমাতেই প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টরের বেশি কৃষিজমিকে বাগদা চাষের ভেড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। জলে অম্লতার ভাগ বেশি ও মাটিতে উপযুক্ত পিএইচ ফ্যাক্টর থাকায় এই দুই নদীর তীরে বাগদা চাষ হয় ভাল।
অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বিঘার পর বিঘা চাষজমিকে ভেড়িতে পরিণত করায় নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। জেলার প্রাক্তন সভাধিপতি তথা খেজুরির তৃণমূল বিধায়ক রণজিৎ মণ্ডল জানান, অবৈধ বাগদা চাষের ফলে কৃষিজমি ক্রমশ উবরর্তা হারিয়ে বন্ধ্যাজমিতে পরিণত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাগদা চাষের পুকুরে জল ঢোকানো ও বার করার জন্য নদী বা সমুদ্র বাঁধ কাটা হচ্ছে যথেচ্ছ ভাবে। ফলে বাঁধগুলি ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। রণজিৎবাবু বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি আধুনিক প্রযুক্তিতে বাগদা চাষের বিরোধী নই। কিন্তু যে ভাবে নিজের লাভের জন্য অন্যের কৃষিজমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না।” |
|
চলছে বাগদা চাষ। —নিজস্ব চিত্র। |
কৃষকেরাই বা চাষবাস ছেড়ে বাগদা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কেন?
বাগদা চাষি শম্ভুরাম পাত্র জানান, এক একর জমিতে ধান চাষ করতে খরচ পড়ে ১৫-১৬ হাজার টাকা। কিন্তু যে ধান উৎপন্ন হয়, তা বিক্রি করে ১২-১৩ হাজার টাকাও ওঠে না। অথচ এক একর জমিতে বাগদা চাষ করতে যেখানে খরচ পড়ে ৫ লক্ষ টাকা, সেখানে আয় হয় সাড়ে ছয় থেকে সাত লক্ষ টাকার মতো। অর্থাৎ বছর প্রায় দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা লাভ হয় বাগদা চাষে।
কিন্তু সব সময় এতটা লাভও হয় না। চাষিরা বাগদা বিক্রি করেন যাঁদের, সেই সমস্ত মধ্যস্থতাকারীরাই অনিয়ন্ত্রিত এই বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক। তাঁদের খেয়ালে অনেক সময়ই ঠিকমতো দাম না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়েন বাগদা চাষিরা। পূর্ব মেদিনীপুর বাগদা চাষ ও চাষি বাঁচাও কমিটির সম্পাদক মদন মণ্ডলের দাবি, গত বছর যেখানে ২৫ হাজার মেট্রিক টন বাগদা রফতানি হয়েছিল, এ বার সেখানে ১২ হাজার মেট্রিক টন বাগদা রফতানি হয়েছে। এই হিসাবে গতবারের তুলনায় প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
এ দিকে, একবার জমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে দিলে আর সাধারণ চাষবাস করা সম্ভব নয়। ফলে চাষে ফিরতে চাইলেও উপায় থাকে না কোনও। লোকসানের ধাক্কা সামলাতে না পেরে চলতি বছরেই জেলার ৫ জন বাগদা চাষি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে জানান মদনবাবু। তিনি বলেন, “বাগদা চাষ করতে গিয়ে লোকসানে পড়ে কাঁথি ৩ ব্লকের চিন্ময় বেরা, অর্ধেন্দু কর, জয়নারায়ণ সিংহ, দেশপ্রাণ ব্লকের শক্তিপদ মণ্ডল, খেজুরির সুশান্ত মণ্ডল আত্মহত্যা করেছেন। বাজারের উপর সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ না-থাকার ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বাগদা চাষিদের স্বার্থ দেখছে না কেউ।”
এই পরিস্থিতির কথা মেনে নিয়ে সহ-মৎস্য অধিকর্তা (নোনাজল) পিনাকীরঞ্জন দে বলেন, “কোটি-কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বলেছি বিষয়টা দেখতে।” অধিকাংশ বাগদা চাষ অবৈধ হওয়ায় এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলে জানিয়েছে মৎস্য দফতর।
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|