বছর পেরিয়ে স্কোয়াড ঢুকেছে গ্রামে,
সতর্ক করলেন তৃণমূল নেতা

থার ফাঁকেই সন্ধে নামল। বাঁকশোল গ্রামের ঘরে ঘরে বাজছে শাঁখ। ঘোমটা টেনে উঠে পড়লেন উমাকান্ত মাহাতোর স্ত্রী সবিতা। ২০১০ সালের অগস্টে যৌথ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গিয়েছে ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটি’র নেতা উমাকান্তর। বাড়ির পাশেই শহিদবেদি। সবিতা সেখানে ধুপ জ্বেলে গড় করলেন। বেদিতে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা।
তবে কি গ্রামে পরিবর্তন এসেছে? গ্রামের মহিলারা কলকলিয়ে উঠলেন, “গরিব মানুষের আবার দিনবদল! আমরা একই আছি। তবে যাদের দেখে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, তারা বিকিয়ে গিয়েছে।” খাস লালগড়েও মানুষজন বলছেন, “যারা আগে কমিটি-মাওবাদী ছিল, তারাই এখন তৃণমূল।”
রাজ্যে নতুন সরকার এসেছে দেড় বছর। আর কিষেণজির মৃত্যুর বছর ঘুরছে কাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, উন্নয়নের অস্ত্রেই ঠেকানো গিয়েছে মাওবাদীদের। সত্যিই কি তাই? কমিটির জেলবন্দি নেতা ছত্রধর মাহাতোর স্ত্রী নিয়তি বলেন, “কিচ্ছু পাল্টায়নি। উন্নয়নের সুফল মানুষ পাচ্ছেন না। প্রতিবাদ করলে আগে নির্যাতন জুটত, এখনও তাই।”
কমিটি-নেতার স্মারকবেদিতে তৃণমূলের পতাকা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
ভয়-আতঙ্কের ছবিটাও সেই আগের মতোই। কোথাও গ্রামবাসীরা চাপা স্বরে বলছেন, ‘ওরা (মাওবাদীরা) কিন্তু আছে।’ কোথাও আবার আশঙ্কা, ‘ওরা ঠিক ফিরে আসবে।’ লালগড়ের ভুলাগাড়ায় যেতে বারণ করেছিলেন তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতা। বললেন, “ওখানে স্কোয়াড ঢুকেছে। সাবধান।” তিনি ভুল বলেননি। ভুলাগাড়ায় ঢোকার মুখে বদলে গেল চারপাশ। মাঠে কাজ করছেন মেয়ে-বউরা। নিকোনো দাওয়াতেও শুধু মেয়েরাই। গ্রামটা যেন পুরুষশূন্য। যে মাঠে অপহৃত পুলিশকর্তা অতীন্দ্রনাথ দত্তকে মুক্তি দিয়েছিলেন কিষেণজি, সেখানে গিয়ে অবশ্য কিছু যুবকের দেখা মিলল। তবে কথা বিশেষ বলতে চাইলেন না তাঁরা। শুধু বোঝা গেল কয়েক জোড়া চোখ আমাদের মাপছে।
উল্টো ভয়টাও আছে, পুলিশ আর সিআরপি’র। এক সময়ের ডাকাবুকো এমসিসি নেত্রী চাকাডোবার কাজল সিংহ সর্দার তাই বহু প্রশ্নের মুখেও রা কাড়লেন না। কমিটির আন্দোলনেও পুরোভাগেই ছিলেন কাজল। তখন সংবাদমাধ্যমকে খোলাখুলি সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন তিনি। আজ তিনিই নিশ্চুপ। শুধু বললেন, “আমাদের আর থাকা! জীবনটাই তো সংগ্রাম।”
জঙ্গলমহলের মেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই স্পষ্ট হয় এই কঠিন সত্যটা। যারা মাওবাদীদের দলে যোগ দিয়েছিল, যারা মারা গিয়েছে মাওবাদীদের গুলিতে, যাদের দেহ মিলেছে, যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের সকলের পরিবারের মেয়েরাই দিন কাটাচ্ছে চরম দৈন্যে, আতঙ্কে, হতাশায়। আর যাদের স্বামীপুত্র নিখোঁজ? তাদের জীবনে শূন্যতা আরও তীব্র। ২০১০ সালের জুলাই থেকে নিখোঁজ রিনার স্বামী অজিত গিরি। বিড়িহাঁড়ি বিদ্যাপীঠে ভূগোলের পার্শ্বশিক্ষক ছিলেন তিনি। বেলিয়াবেড়ায় বাপের বাড়িতে বসে রিনা যখন কথা বলছেন, পাশেই বাজছে কানফাটা বক্স ‘ও সাথীরে, তেরে বিনা ভি কেয়া জিনা...’। আর রিনা বলে চলেছেন, “ওর খোঁজে কোথায় যাইনি?” কোলের ফাইলটায় নিখোঁজ ডায়েরির নথি থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে আবেদন, সবই যত্নে রাখা। কিছু সাহায্য পাননি? রিনার জবাব, “নিখোঁজদের জন্য কিছু নেই।”
অন্য রকম শূন্যতায় দিন কাটাচ্ছেন চন্দ্রির অলকা পাল। বছর খানেক নিখোঁজ থাকার পর স্বামী স্বরূপের দেহ মিলেছিল, সম্প্রতি ক্ষতিপূরণের ১ লক্ষ টাকাও পেয়েছেন অলকা। কিন্তু একমাত্র ছেলে সুদীপ্তকে কাছে রাখতে সাহস করেননি, পাঠিয়ে দিয়েছেন হস্টেলে। তাড়া করছে সেই ভয় না জানি আবার কী হয়!
বেলপাহাড়ির চিড়াকুটার গীতা মাহাতোর বাড়ির দাওয়াতেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলেন গীতার স্বামী সুবল। প্রতিরোধ কমিটিতে থাকার শাস্তি দিয়েছিল মাওবাদীরা। তিন বছর কেটে গিয়েছে তার পর। গীতার কথায়, “ক্ষতিপূরণ পাইনি। দু’টো সন্তান নিয়ে শাকভাত খেয়ে বেঁচে আছি।” মায়ের কথার ফাঁকেই কোলের ছেলেটা আঙুল তুলল মাটির দেওয়ালের দিকে। লাল কালিতে জ্বলজ্বল করছে বিপ্লব মাহাতো। ওর নাম।
বঞ্চনা-হতাশার জঙ্গলমহল কি তবে নতুন বিপ্লবের অপেক্ষায়? কমিটির নিহত নেতা উমাকান্তের স্ত্রী সবিতা বলছিলেন, “ব্রেন চাই, ব্রেন। পুলিশ তো মাথাগুলোকে (কিষেণজি) মেরে ফেলল, বাকিগুলোকে হাজতে পুরল। এখন আর একটা মাথা চাই।” অসম্ভব কঠিন মনে হল সবিতার চোখ দু’টো।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.