|
|
|
|
তোলাবাজিতে কাজ স্তব্ধ |
জুলুমেই কপাল পুড়ছে কেলেঘাই-কপালেশ্বরীর |
শুভাশিস ঘটক • কলকাতা |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
নিশুত রাতে আচমকা মাথায় বাড়ি। ধড়ফড়িয়ে খাটিয়ায় উঠে বসে চোখ মেলেই হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড় ঠিকাদারের কর্মীটির।
দেখেন, তাঁর মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে! রিভলভারের বাঁট দিয়ে সে ফের সজোরে মারল তাঁর মাথায়, তার পরে হিড়হিড় করে টেনে বার করল তাঁবু থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে আরও জনা পনেরো সশস্ত্র যুবক। ঠিকা-কর্মীর মুখে-পিঠে বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে তারা শাসানি দিল, “মালিককে বলিস, টাকা নিয়ে দেখা করতে। নয়তো এখানে কাজ বন্ধ। এলে মাটিতে পুঁতে দেব।”
আর ওখানে গিয়ে কাজ করার মতো ‘বুকের পাটা’ হয়নি ঠিকাদারের। পুলিশকে জানিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। তাঁর মতো দশা আরও বেশ কিছু ঠিকাদারের। কেউ প্রাণের ভয়ে কাজ করতে পারেননি। ফলে তোলাবাজদের দাপটে গত ক’মাস ধরে বন্ধই হয়ে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী-বাঘাই নদী সংস্কারের কাজ।
ঠিকাদারেরা জানিয়েছেন, ‘তোলা’র টাকা না-দেওয়ায় গত জুনে প্রকল্পের কিছু কর্মীকে মারধর করা হয়েছিল। আটকে রাখা হয়েছিল ড্রেজিং মেশিন। পুলিশ গোড়ায় কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও অবস্থা শুধরোয়নি। এমনকী, সেচ দফতরের এসডিও (অনুসন্ধান) অর্ধেন্দু মাইতি স্বয়ং ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকেও বেধড়ক পেটানো হয় বলে অভিযোগ। অর্ধেন্দুবাবু ছুটিতে চলে যান। আতঙ্কে কাজ বন্ধ করে দেন ঠিকাদারেরা।
তার পরে চার-পাঁচ মাস কেটে গিয়েছে। কাজ থমকেই রয়েছে। ঠিকাদারদের দাবি: প্রকল্প-এলাকায় তাঁদের চার-চারটে ড্রেজিং মেশিন আটকে রাখা হলেও পুলিশ তা উদ্ধারে গা ঘামাচ্ছে না। উপায়ান্তর না-দেখে তাঁরা রাজ্য সরকারের সেচ মনিটরিং ভিজিল্যান্স কমিটির দ্বারস্থ হয়েছেন। এখনও কোনও সমাধান হয়নি। ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের অভিযোগ: তোলাবাজেরা তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা অবশ্য জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁদের দলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। |
|
সেচ-সূত্রের খবর: ২০১১-১২ অর্থবর্ষে কেলেঘাই-কপালেশ্বরী-বাঘাই নদী সংস্কারে প্রায় সাড়ে ছ’শো কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনের মুখে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকারের সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর ওই বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেন। কাজের সূচনা হয় ২০১২-র ১৭ ফেব্রুয়ারি, ভগবানপুর থানার কাঁটাখালে। তত দিনে অবশ্য রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গিয়েছে। প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া।
সেচ-কর্তারা জানাচ্ছেন, সরকারি সংস্থা ম্যাকিনটস বার্ন প্রকল্প রূপায়ণের বরাত পেয়েছে। তারা একাধিক ঠিকাদারকে কেলেঘাই (২২কিমি), বাঘাই (১২কিমি), চণ্ডিয়া (৮কিমি), কপালেশ্বরী (২০কিমি) নদী এবং ১৪টি খাল সংস্কারের ভার দেয়। অভিযোগ, প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হতে না-হতেই তোলাবাজদের খপ্পরে পড়েন ঠিকাদারেরা। সবং ব্লকের লাঙ্গলকাটা থেকে শুরু করে ময়না ব্লকের ঢেউভাঙা পর্যন্ত প্রকল্প-এলাকায় জনা দশেক ঠিকাদারের কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকা ‘তোলা’ চাওয়া হয়। শুরু হয় হুমকি-মারধর।
আর তারই জেরে থেমে গিয়েছে কাজ। পুলিশ কী করছে?
সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরা পুলিশ ও সেচ দফতরকে লিখিত নালিশ করেছেন। তবু পুলিশ নিষ্ক্রিয় বলে ওঁদের অভিযোগ। পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশ জৈন অবশ্য বলেন, “ঠিকাদার ও সেচ-কর্মীদের মারধরের ঘটনায় কিছু অভিযুক্তকে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম। ফের অভিযোগ দায়ের হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঠিকাদারেরা অবশ্য এসপি-র আশ্বাসে তেমন ভরসা পাচ্ছেন না। ওঁরা বলছেন, “প্রথম বার অভিযোগ পেয়ে পুলিশ এক জনকে গ্রেফতার করলেও সে জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। পরে আবার হুমকি এসেছে। তখনও পুলিশকে জানানো হয়েছিল, কিন্তু লাভ হয়নি।” তোলার দাবিতে জুলুমবাজি চালাচ্ছে যারা, তারা স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট বলে পুলিশকে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরা। এবং ওঁদের আক্ষেপ, অভিযুক্তদের ‘শাসক-ঘনিষ্ঠতা’র সুবাদেই পুলিশ হাত গুটিয়ে রয়েছে। নেতারা কী বলেন?
ময়না ব্লক তৃণমূলের সহ-সভাপতি মিলন ভৌমিকের দাবি, “তোলাবাজেরা আমাদের দলের কেউ নয়। তবে দলের তরফে তদন্ত করে দেখছি।” পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ- সভাধিপতি মামুদ হোসেনও অভিযোগ মানতে নারাজ। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি গাঁধী হাজরার মন্তব্য, “ওখানে কিছু দুষ্কৃতী তোলা আদায়ের জন্য ঠিকাদারদের উপরে হামলা চালিয়েছিল। তবে তৃণমূলের সঙ্গে ওদের যোগ নেই।”
তা হলে কি টাকা মজুত থাকা সত্ত্বেও স্রেফ তোলাবাজের জুলুমে নদী সংস্কার বন্ধ থাকবে? পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক পারভেজ আহমেদের আশ্বাস, “আমি কয়েক জন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা জানিয়েছেন, কাজ শুরু করবেন।” সেচ দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার(২) বরুণ ঘোষের মন্তব্য, “পরিস্থিতিতে নজর রাখা হচ্ছে।” রাজ্যের প্রাক্তন সেচমন্ত্রী মানসবাবু প্রতিক্রিয়া, “আশা করি, মুখ্যমন্ত্রী সব সমস্যার সমাধান করে প্রকল্প সম্পূর্ণ করার ব্যবস্থা করবেন।”
উল্লেখ্য, মানসবাবু সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়ার পরে এত দিন মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই ছিল সেচ দফতরের ভার। বুধবার রাজ্যের নতুন সেচমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্তমান সেচমন্ত্রীর কী বক্তব্য?
জিজ্ঞাসা করা হলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজীববাবু বলেন, “সেচ-প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা কী, আজই আমি সে ব্যাপারে অফিসারদের সঙ্গে বসে পর্যালোচনা করেছি। কেলেঘাই-কপালেশ্বরীর মতো বড় প্রকল্পের কাজ কেন থমকে আছে, কাল (শুক্রবার) দুপুরের মধ্যে আমাকে তার রিপোর্ট দিতে বলেছি। রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধানে ব্যবস্থা নেব। কাজ চালু করে দেব।”
আপাতত মন্ত্রীর এই আশ্বাসই ভরসা তিরিশ লক্ষ মানুষের। |
|
|
|
|
|