বছর দেড়েক আগে দিল্লিতে বীরেন্দ্র সহবাগের নতুন বাড়িতে আমরা দু’জন আড্ডা মারছি, এক সাংবাদিক এলেন। তাঁর একটা প্রশ্ন ছিল সহবাগের কাছে আপনার কাছে টেস্ট আর ওয়ান ডে ব্যাটিংয়ের পার্থক্য কী? বীরু একটা বাক্যে উত্তর দিল চেঞ্জ অব ক্লোথ্স।
এই হচ্ছে বীরু।
আসলে বীরুর ব্যাটিংটা ওর জীবনের মতোই সহজ-সরল। যেমন ওর বাড়িটা সুন্দর ভাবে সাজানো, অথচ অনাড়ম্বর। আমার মনে হয়, টেকনিকের চেয়েও বীরুর ব্যাটিংয়ে অসাধারণ প্রয়োগক্ষমতা আর মগজাস্ত্র ওর অনবদ্য সাফল্যের রসায়ন। চোখ আর হাতের কো-অর্ডিনেশনের থেকেও ওর ব্যাটিংয়ে চোখ আর মাথার কো-অর্ডিনেশন বেশি। যে কোনও বল খেলার সময় বীরু সেটাকে ছয় মারার কথা প্রথম ভাবে। তার পরে ভাবে চার মারার কথা। তার পরে দুই বা সিঙ্গলস নেওয়ার কথা। সবশেষে ডিফেন্স করার কথা। যেটা আমার মতো ব্যাটসম্যানরা ভাববে ঠিক উলটো ভাবে প্রথমে ডিফেন্স, সবার শেষে ওভার বাউন্ডারি।
তাও বীরুকে যখন টেস্টে ওপেন করতে বলা হয়েছিল, সত্যি বলতে কী আমি অবাকই হয়েছিলাম। বীরু ওপেনার! ওপেনার বলতে তো জানি, সে নতুন বলটা দেখেশুনে খেলবে। প্রতিপক্ষের এক নম্বর পেসারকে মারার কোনও ঝুঁকি নেবে না। ধরে ধরে খেলে ইনিংসের ভিত তৈরি করবে। কিন্তু সহবাগ সোজা কথায়, টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটিং ওপেনিংয়ে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ও টেস্টের প্রথম বলটাই শর্ট, অফ স্টাম্পের বাইরে পেলে একশো বারের মধ্যে একশো বারই সপাটে কাট মারবে। এক নম্বর পেসারকেই টার্গেট করবে পেটানোর। যাতে সেই পেসার তো বটেই, সঙ্গে তার পুরো টিমও মানসিক ভাবে ধসে পড়ে। এবং সেই কাজটা বীরু যে আনকা খেলে করে তা আদৌ নয়। ধুমধড়াক্কা খেলে টেস্টে দু’টো ট্রিপল সেঞ্চুরি আর একটা ২৯০-ঘরে স্কোর কেউ কখনও করতে পারে না। |
ব্লুমফন্টেনে এগারো বছর আগে বীরু আর আমার একসঙ্গে টেস্ট অভিষেক ঘটেছিল। টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা আমাদের ব্যাট করতে পাঠাল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ভারত ৬০-এর ঘরে ঢুকতেই চার উইকেট পড়ে গেল। সচিন যদিও একটা দিকে বেশ জমে গিয়েছে। কিন্তু ওকে তেমন ভাবে কেউ তখনও সাহায্য করতে পারেনি। বীরু ওই অবস্থায় ক্রিজে গেল। এতক্ষণ প্যাড-ট্যাড পরে আমরা দু’জন ড্রেসিংরুমের সামনে পাশাপাশি বসে খেলা দেখছিলাম। যে রকম হারে আমাদের উইকেট পড়ছিল, সত্যি বলতে কী, ধরেই নিয়েছিলাম, যে কোনও সময় আমাকেও ক্রিজে যেতে হবে। নার্ভাস লাগছিল।
কিন্তু বীরুর মধ্যে যেটা প্রথমেই লক্ষ্য করেছিলাম, ক্রিজে নেমে হাবভাব-হাঁটাচলায় এক বারও প্রতিপক্ষকে বুঝতে দিল না যে, এই সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটে ও একেবারে আনকোরা। টেস্টে আবির্ভাবেই সচিনের সঙ্গে পার্টনারশিপ। বীরু কিন্তু বিন্দাস। শন পোলকের মতো কিংবদন্তি ফাস্ট বোলারের ওভারে চারটে বল খেলতে গিয়ে মিস করছে। কুছ পরোয়া নেই। বাকি যে দু’টোয় ব্যাটে-বলে হচ্ছে, দু’টোই বাউন্ডারি। অন্য দিকে সচিন দুর্দান্ত একটা দেড়শো রানের ইনিংস খেলে যখন আউট হল, বীরু ৭০-এর মতো। ভারত ২৮৮-৬। অনেকটাই ভাল জায়গায়। ড্রেসিংরুম ফেরত সচিনের পাশ দিয়ে আমি মাঠের ভেতর ঢুকলাম।
এই অবস্থায় সব নতুন ব্যাটসম্যানই সিনিয়র পার্টনারকে যা জিজ্ঞেস করে, আমিও ক্রিজে গিয়ে বীরুকে সেটাই করলাম। কী বুঝছিস? কী হচ্ছে বল এখানে? বীরু একগাল হেসে বলল, সব হচ্ছে এখানে। বাইরে যাচ্ছে। ভেতরে আসছে। ছুটছে। লাফাচ্ছে। তুই শুধু বলটা দেখে চালা।
এই হচ্ছে বীরু। টেস্ট জীবনের প্রথম দিন থেকেই। বল দেখে চালাও।
নিরানব্বইটা টেস্টে যে দর্শন নিয়ে ব্যাট করেছে, আমি নিশ্চিত একশো নম্বরটাও সে ভাবেই ওয়াংখেড়েতে খেলবে। নিজের শততম টেস্ট বলে অন্য রকম কিছু ভাববে না। |