সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ওয়াংখেড়ের ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে পড়তে দেখা গেল দু’জনকে।
এক জন সাড়ে পাঁচ ফুটের একটু বেশি। অন্য জন পুরোপুরি সাড়ে পাঁচ। প্রথম জন, রোজের মতো আজও স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া। তাঁর ব্যাটের খিদের সামনে পড়ে নেটে ইশান্ত-হরভজনদের দশাকে যদি সূচক ধরা হয়, তা হলে আমদাবাদ-উত্তর মুম্বই টেস্টেও কিন্তু তাঁর রানভোজনের গল্প থাকছে। অন্য জন? চল্লিশের চৌকাঠে পৌঁছেও আজও ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্র। ইদানীং টেস্টের আগের দিন নকিংয়ের সঙ্গে ব্যাটিং প্র্যাক্টিসও জুড়েছেন।
বীরেন্দ্র সহবাগ এবং সচিন তেন্ডুলকর।
আরব সাগরের পারে এক জন দাঁড়িয়ে শততম টেস্টের সৈকতে। অন্য জন ঘরের মাঠে জীবনের শেষ টেস্ট খেলতে নামছেন।
তথ্য দুটো অজানা নয়। কিন্তু সাড়ে দশটার ওয়াংখেড়ে ইঙ্গিত দেয়নি এই দুই মহানায়কের মহাকীর্তিকে ঘিরে বাকি দিনে কী ঘটতে চলেছে। বোঝা যায়নি, তাঁদের নিয়ে এমন আবেগের হিস্টিরিয়াও তৈরি হতে পারে ভারতের ব্যস্ততম শহরে। বিশেষ করে সহবাগকে ঘিরে। তাঁর শততম টেস্টের ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাউন্টডাউন যত এগোচ্ছে, তত যেন উত্তেজিত হচ্ছে মুম্বই। হাতে গরম উদাহরণ চাই? |
চার বছর আগে কসাবের জঙ্গিহানায় তাজের সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিল যে হোটেল, সেই ট্রাইডেন্টে বসে শেন ওয়ার্ন নির্লিপ্ত গলায় জানিয়ে দিচ্ছেন, শততম টেস্টেও সহবাগের ব্যাট ‘কসাব-সুলভ’ আচরণই করবে! “ওকে বল করতে কে কোন দিন পছন্দ করেছে? আবার পুড়বে ইংরেজ বোলিং!”
সঞ্জয় মঞ্জরেকর টুইটে ধন্যবাদ দিচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। লিখছেন, “টেস্টে ওপেনার সহবাগের কাছ থেকে আমরা যা আনন্দ পেয়েছি, তার জন্য গাঙ্গুলিকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ব্যাটিং অর্ডারে সহবাগকে উপরে তুলে আনাটা মাস্টারস্ট্রোক ছিল।”
কপিল-বেঙ্গসরকরের সাফ কথা, সেঞ্চুরি টেস্টে সহবাগের ব্যাট থেকে বিস্ফোরণ চাই। আসুক সেঞ্চুরি।
ধোনি যে ধোনি, বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতিয়েও যাঁর ঠোঁটে চিলতে হাসি ছাড়া কিছু দেখা যায় না, তাঁকে পর্যন্ত বিগলিত গলায় বলতে শোনা গেল, “বীরুকে নিয়ে আর কী বলব? ফর্মে থাকুক আর না থাকুক, শততম টেস্ট হোক চাই না হোক, নেমেই চালাবে। মাইন্ডসেটটাই আলাদা।”
একটার পর একটা অনুষ্ঠান। আসন্ন উৎসবের ছবি আগাম ভেবে নিয়ে একটার পর একটা রঙিন মুহূর্ত। শততম টেস্টের কীর্তির জন্য মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা এ দিন স্মারক তুলে দিল ভারতের বিস্ফোরক ওপেনারের হাতে। কিন্তু আবেগের বক্স অফিসে সচিনও খুব পিছিয়ে রইলেন কি? সন্ধের সিসিআইতে লিটল মাস্টারের উপর বই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে যখন সচিনের গলা নকল করা শুরু করলেন রাহুল দ্রাবিড় সেলিম দুরানি-অংশুমান গায়কোয়াড়দের হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ার কী মানে? বা ভারত অধিনায়কের বলে বসা, “সচিন ওয়াংখেড়েতে শেষ টেস্ট খেলছে কি না, তা নিয়ে কথা বলে লাভ আছে? যদি পরে ও এখানে আরও গোটা কয়েক টেস্ট খেলে, তখন?”
গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হবে, উত্তেজনার সিরিজে বোধহয় এখন উৎসবই মুখ্য। ২-০ হবে কি হবে না, সেটা গৌণ। কিন্তু ঘটনা হল, খবর আছে খবরের মতো। জবাব, পাল্টা জবাব আছে। ধোনিকে ওয়ার্নের খোঁচা আছে। পিচ নিয়ে বিতর্কের সিরিজও বন্ধ হয়নি। কিন্তু কোনও কিছুই যেন উৎসবের মেজাজকে পাশ কাটিয়ে বেরোতে পারছে না। |
ওয়াংখেড়েতেও নেই হরভজন সিংহ। ভারত দুই পেসারের সঙ্গে দুই স্পিনারই খেলাবে। উমেশ যাদবও নেই। এবং তাঁর বদলি নিয়েই যত জল্পনা। জাহিরের সঙ্গী কে? ইশান্ত না অশোক দিন্দা? ধোনি উত্তরটা ঝুলিয়ে রাখলেন। কিন্তু স্টিভ-প্রসঙ্গে তাঁর উত্তর পাওয়া গেল। “স্টিভ কী বলেছে, জানি না। যে যা খুশি বলতেই পারে। কিন্তু আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি।” তখনও জানতেন না যে, ঘণ্টাখানেক পর ওয়ার্নও (যিনি মুম্বই টেস্টে কমেন্ট্রি বক্সে থাকছেন) শুনিয়ে যাবেন, “আমরা কোনও দিন কিউরেটরের উপর খবরদারি করিনি। ধোনি ডাকাবুকো ক্যাপ্টেন। কিন্তু সেটা দেশে। বিদেশে কী মনোভাব নিয়ে নামতে হয়, ওকে শিখতে হবে!” পিচ-পর্বেও দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনের ব্যাপার নেই। ওয়াংখেড়ের উইকেট এখনও পর্যন্ত ঠিক মনে হয়েছে ধোনির। মোতেরার চেয়ে বেশি টার্ন আশা করছেন। কিন্তু ‘এখনও’ শব্দটা এই কারণে রাখতে হচ্ছে যে, ‘ক্যাপ্টেন কুল’ ফুটনোটের মতো নিজেই শেষে জুড়ে গেলেন, পাঁচ দিন পর তাঁর ‘রিভিউ’ পাল্টাতেও পারে!
না পাল্টালেও ক্ষতি নেই। বিপক্ষের যা অবস্থা! মন্টি পানেসরকে ফেরানো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাতে সমস্যা মিটছে কই? ভারতীয় স্পিনের পাল্টা ফর্মুলা এখনও বার করা যায়নি। অ্যালিস্টার কুক শরণাপন্ন হয়েছেন গ্রাহাম গুচের। জিজ্ঞেস করেছেন, কী করা যায়? গুচ নাকি মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছেন, “সবচেয়ে ভাল হচ্ছে, নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে থাকা!” সচিন-সহবাগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আসেনি টিম ইংল্যান্ড। জানানো হয়েছে, টিম স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে ব্যস্ত। করেও বা কত লাভ? উইকেট তো দেখতে গেলে দু’টো। কেভিন পিটারসেন আর ইংরেজ অধিনায়ক নিজে। যিনি আবার কেপি-র প্রবল প্রশংসা করেও বলে গেলেন, দায়িত্বের সিংহভাগ তাঁকে নিজেকেই নিতে হবে।
ধোনিরাও জানেন সেটা। উৎসবের সমুদ্রে কুকই তো এক নম্বর চোরাবালি!
|