নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই নির্দেশের যাতে যথাযথ পালন হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে বার্তা পাঠিয়েছিলেন পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যসচিব তথা বর্তমানে রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। তা -ও যে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালের ‘আউটডোর ট্র্যাকিং সিস্টেম’-এ ফাঁকিবাজি ঠেকানো যায়নি, তা স্বীকার করছেন স্বাস্থ্যকর্তারাই।
গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের সরকারি রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে, কলকাতার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্য ভবনে আউটডোর সংক্রান্ত বাধ্যতামূলক রিপোর্ট পাঠায়নি। অনেক হাসপাতাল থেকে টানা ১০ -১২ দিন রিপোর্ট আসেনি। আবার একাধিক হাসপাতাল টানা দু’মাস এক দিনেরও রিপোর্ট পাঠায়নি। তার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য দফতর। যতটুকু রিপোর্ট এসেছে, তা -ও কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিশ্চিত করারও কোনও পরিকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি। যদি কেউ মোবাইলে মনগড়া তথ্য পাঠান, তা হলে সেই তথ্য যাচাইয়ের পন্থা এখনও স্বাস্থ্য দফতরের হাতে নেই। অথচ, ভেজাল তথ্যের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে আউটডোর ঠিক সময়ে চালু হয় না, দূরদূরান্ত থেকে অসুস্থ রোগীরা এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন, আউটডোরে এক বার মুখ দেখিয়ে সই করে চিকিৎসকেরা অন্য কাজে চলে যান এ রকম অসংখ্য অভিযোগ দিনের পর দিন বাড়ছিল বলেই ‘ওপিডি ট্র্যাকিং’ চালু করার কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক হয়েছিল, প্রত্যেকটি সরকারি হাসপাতালের সুপারেরা প্রতিদিন সকালে তাঁদের মোবাইল থেকে রাজ্য স্বাস্থ্য -অধিকর্তার মোবাইলে আউটডোর সংক্রান্ত তথ্য পাঠিয়ে দেবেন।
কোন বিভাগে আউটডোর খুলতে দেরি হয়েছে, কোন আউটডোরে চিকিৎসক আসেননি বা দেরি করে এসেছেন সব তথ্যই পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, বিষয়টি পুরনো হতেই ফের আগের অবস্থা ফিরে এসেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য দফতর কারোওই রিপোর্ট নিয়ে আর মাথাব্যথা নেই।
আউটডোর সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কলকাতার যে ক’টি হাসপাতাল কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি (আরআইও ) , বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি (বিআইএন ) , চিত্তরঞ্জন সেবা সদন, লেডি ডাফরিন হাসপাতাল, পাভলভ হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি, নর্থ সাবার্বান হাসপাতাল, রামরিকদাস হরলালকা হাসপাতাল, বিসি রায় পোলিও হাসপাতালের মতো অনেকে। স্বাস্থ্য দফতর থেকে প্রকাশিত রিপোর্টই জানাচ্ছে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবরের মধ্যে আরআইও, লেডি ডাফরিন, বিআইএনের মতো হাসপাতাল আউটডোরের কোনও রিপোর্ট পাঠায়নি। রামরিকদাস হাসপাতালের ১৫ দিনের, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ১২ দিনের, ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রির ১৯ দিনের, চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের ১০ দিনের, নর্থ সাবার্বান হাসপাতালের ১৫ দিনের রিপোর্ট আসেনি।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ১ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বরের মধ্যে ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি, রামরিকদাস হরলালকা, বিআইএন, আরআইও এক দিনেরও রিপোর্ট পাঠায়নি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৫ দিনের আউটডোর রিপোর্ট জমা পড়েনি। চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের ১০ দিনের, পাভলভের ৯ দিনের, বিসি রায় পোলিও হাসপাতালের ১০ দিনের রিপোর্টও পায়নি স্বাস্থ্য দফতর।
আরআইও -র অধিকর্তা গৌতম ভাদুড়ীর জবাব, “৩১ অগস্ট অবসর নিয়েছিলাম। তার পরে কিছু দিন কেউ রিপোর্ট পাঠাননি। আমি অক্টোবরে পুনর্নিযুক্ত হই। কিন্তু তখন হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক যন্ত্র খারাপ ছিল। সেগুলি সারানো নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আউটডোরের রিপোর্ট পাঠাতে পারিনি।” চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের সুপার আশিস মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “আমি নিজে আউটডোর করি বলে রিপোর্ট পাঠানোর দায়িত্ব অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারকে দিয়েছিলাম। রিপোর্ট পাঠানোয় যে ছেদ পড়েছে, জানতাম না।” রামরিকদাস হাসপাতালের সুপার নিখিলরঞ্জন রায়ের কথায়, “আমি অন্য এক জনকে দায়িত্বটা দিয়েছিলাম। সে পাঠাতে পারেনি।” মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ আবার বেশি রাখঢাক না করেই বলেছেন, “পাঠিয়ে লাভটা কী? কে পাঠাল, কে পাঠায়নি, যারা পাঠিয়েছে তারা তথ্যে জল মিশিয়েছে কি না, সে সব কিছুই তো স্বাস্থ্য দফতর দেখে না। যারা পাঠায় না, তাদের শাস্তিও হয় না।” সব মিলিয়ে আউটডোরের তথ্য আসা বাড়াবাড়ি রকম কমে যাওয়ায় বিব্রত স্বাস্থ্য দফতর। এখন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলছেন, “নরম মনোভাব দেখানো হয়েছে বলে অনেক হাসপাতাল তথ্য পাঠানো বন্ধ করেছে। এ বার প্রত্যেককে হুঁশিয়ারি পাঠানো হয়েছে, আউটডোরের তথ্য জানাতে এতটুকু ফাঁক থাকলে কড়া শাস্তির জন্য তৈরি থাকতে হবে।” |