একশো দিনের মাথায় দাবি করেছিলেন, ৯০ শতাংশ কাজই সেরে ফেলেছেন। দেড় বছর পরে তাঁর উপলব্ধি, অনেক কাজই হয়নি। আর সে জন্য বুধবার মন্ত্রী-আমলাদের কড়া কথা শোনালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
না-হওয়া কাজের তালিকার শীর্ষে অবশ্যই শিল্প। উৎসব অনুষ্ঠান নিয়েই সরকার ব্যস্ত, শিল্পায়নের দিকে নজর নেই লগ্নিকারীদের এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যদিও শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, নতুন সরকারের আমলে ১ লক্ষ ৯ হাজার কোটি টাকার লগ্নি এসেছে, স্থাপিত হয়েছে ২২২টি নতুন শিল্প। তাঁর এই সংখ্যাতত্ত্ব যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই মানছেন না, সেটা স্পষ্ট হয়েছে বুধবার। এ দিন টাউন হলে মন্ত্রী-আমলাদের নিয়ে সরকারের কাজের পর্যলোচনা করতে বসে মমতা শিল্পমন্ত্রীকে বলেন, দেড় বছরে কী হয়েছে? শুধু তো শিলান্যাস হয়েছে? বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি শিল্প পার্ক হয়েছে কিন্তু তাতে বিনিয়োগ হয়নি। বার বার সচিব বদল হয়েছে কিন্তু তাতেও কাজের কাজ হয়নি। বড় শিল্প যখন আসছেই না, তখন ছোট শিল্পগুলির উপরে নজর দেওয়ার জন্য পার্থবাবুকে পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী।
শিল্পায়নের অন্যতম প্রাক্শর্ত পরিকাঠামো নিয়েও এ দিন নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মমতা। পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদারকে তিনি বলেন, রাজ্যের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। কলকাতার বাইরে চলাফেরাই দায়। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, টাকা সব দিয়ে দেওয়া হলেও কাজ হচ্ছে না কেন? এখানেই না থেমে এর ভবিষ্যৎ ভাল হবে না বলে পূর্তমন্ত্রীকে সতর্ক করে দেন তিনি। তাঁকে নির্দেশ দেন নিজে উদ্যোগী হয়ে কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, শিল্পায়ন নিয়ে লাগাতার সমালোচনা মমতার উপরে চাপ বাড়াচ্ছে। মঙ্গলবার শিল্প দফতরের সচিব এবং শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর বদল আর বুধবার এই মন্তব্য সেই চাপেরই বহিঃপ্রকাশ। প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, শিল্পোন্নয়ন নিগমের পাশাপাশি তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরেরও দায়িত্বে ছিলেন নন্দিনী। ফলে শিল্পের কাজে তাঁর পক্ষে পুরো সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বেশ কিছু অভিযোগও এসেছিল। শিল্পের জন্য ঋণদান, শিল্পপার্কে জমি বিলি এবং লগ্নিকারীদের জন্য উৎসাহ ভাতা বণ্টনে পক্ষপাতিত্ব হয়েছে বলে বিভিন্ন বণিকসভা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, কৃষ্ণ গুপ্তের মতো আমলাকে নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে মমতা শিল্পপতিদেরও খুশি করতে চেয়েছেন।
আগের শিল্পসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেও ছিল পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব। ফলে তাঁরও সমস্যা হচ্ছিল। নয়া শিল্পসচিব চঞ্চলমল বাচোয়াত সৎ এবং ঋজু স্বভাবের অফিসার বলে পরিচিত। চরম অর্থসঙ্কটের সময়ে তিনি রাজ্যের অর্থসচিব ছিলেন। এ বার তাঁর কাঁধে লগ্নি আনার গুরুদায়িত্ব চাপল।
যদিও এই রদবদলে কাজের কাজ কতটা হবে তা নিয়ে শিল্পমহলেরই সন্দেহ রয়েছে। অনেক শিল্পপতির মতে, এ রাজ্যে শিল্পায়নের পথে মূল অন্তরায় নেতিবাচক ভাবমূর্তি আর জমি-জট। এই দুই সমস্যার সমাধান সরকারের নীতি বদল। যার কোনও ইঙ্গিত মুখ্যমন্ত্রী এখনও দেননি।
ঘটনাচক্রে এ দিনই শিল্পমন্ত্রীর সামনে জমি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বণিকসভা বেঙ্গল চেম্বার অফ কর্মাস। তাদের বক্তব্য, প্রশাসন দাবি করছে শিল্পের জন্য জমির অভাব হবে না। কিন্তু লগ্নিকারীরা বুঝতে পারছেন না, সেই জমি কোথায় রয়েছে? কী ভাবেই
তা মিলবে? ল্যান্ড-ব্যাঙ্কের প্রসঙ্গ তুলে চেম্বারের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্ত আর্জি জানান, ল্যান্ড-ব্যাঙ্কের জমি কোথায় আছে, কতটা আছে তা স্পষ্ট ভাবে জানাক সরকার। তিনি বলেন, “আপনারা কেন ল্যান্ড-ব্যাঙ্কের তথ্য প্রকাশ করছেন না? লগ্নিকারীরা এ নিয়ে কিছু জানেন না। এটা প্রকাশ করা হলে তাঁদের সুবিধা হবে।”
জবাবি বক্তৃতায় স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি পার্থবাবু। ফের প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, “ল্যান্ড ব্যাঙ্কের কাজ চলছে। আমাদের (শিল্প দফতরের বিভিন্ন বিভাগের) হিসেব ওয়েবসাইটে দিয়ে দিয়েছি।” ল্যান্ড ব্যাঙ্কের উপর যে শিল্পমহলের বিশেষ আস্থা রয়েছে তা নয়। কারণ, বড় শিল্পের উপযোগী একলপ্তে অনেকটা জমি সরকারের হাতে নেই। ফলে শিল্প গড়তে গেলে জমি কিনতেই হবে। কিন্তু বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে মমতা সরকারের ঘোর অনীহা। ফলে রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আর শিল্পায়ন না হওয়ায় রাজ্যে অপরাধ বাড়ছে বলেই মনে করছেন কল্লোলবাবু। তাঁর কথায়, “নতুন কর্মসংস্থানের সমস্যার জন্যই এখানে ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।”
শিল্পায়ন না-হওয়ার কারণে তৈরি হওয়া এই সামাজিক সমস্যার কথা অবশ্য মানতে চাননি পার্থবাবু।
দারিদ্র ঘোচাতে শিল্পায়নের লক্ষ্যে তাঁর সরকার যে খুব বেশি এগোতে পারেনি, তা এ দিনের সভায় কার্যত কবুল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পায়নের লক্ষ্যে কী কী কাজ হয়েছে, তার একটি তালিকা মমতার হাতে ছিল। তা দেখে তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে জরি হাব, ফুড পার্ক, ফাউন্ড্রি পার্ক-সহ ৪-৫টি শিল্পতালুকের শিলান্যাস হলেও কোথাও ‘কাজ চলছে’, কোথাও ‘সবে জমি মিলেছে’, আবার কোথাও ‘টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে’ বলে লেখা হয়েছে। তিনি এ সব বোঝেন না। মন্ত্রী-সচিবদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেবেন। তাঁর পক্ষে যে ছোটখাটো সব বিষয় দেখা সম্ভব নয় তা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, কাজ এগোচ্ছে নয়, তিনি দেখতে চান কাজ শেষ হয়েছে।
শিল্পমহল অবশ্য বলছে, কাজ আটকে মমতার নীতির জটেই। |