প্রবন্ধ ২...
উৎসব মানেই রক্তশূন্যতা
খুব সমস্যায় পড়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। রক্তের আকাল। তাঁর সরকার বিজ্ঞাপন দিয়ে সমানে প্রচার চালাচ্ছে। কয়েকটা কালো রঙের জবরদস্ত ভ্যান আর বেশ কিছু কর্মী বরাদ্দ হয়েছে ঘুরে-ঘুরে রক্ত সংগ্রহের জন্য। কিন্তু কিছুতেই স্বেচ্ছা রক্তদান সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ ভাঙা যাচ্ছে না। কেউ রক্তদানে রাজি নন। কর্মীরা পাড়ায়-পাড়ায় রক্তদানের প্রচারে গেলেই লোকে ‘রক্তচোষা এসেছে’ বলে পালাচ্ছে।
ইন্দুমতী সভাগৃহে স্মৃতিচারণ করছিলেন রক্তদান আন্দোলনের প্রবীণকর্মী দেবব্রত রায়। কলকাতায় স্বাধীন ভারতের প্রথম সংগঠিত স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সে দিনের রক্তদাতাদের পুনর্মিলন উৎসব।
স্মৃতিচারণ করছিলেন শিবশঙ্কর রায়। পঞ্চাশ বছর আগে সেই রক্তদান শিবিরে বিশাল কালো রঙের নেওয়ার বোতল, কালো মোটা পাইপ আর বিঘতপ্রমাণ সুচ দেখে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র শিবশঙ্করের সামাজিক দায়-টায় মাথায় উঠেছিল। ‘একটু আসছি’ বলে শিবির থেকে পালিয়ে সোজা বাড়ি। কিন্তু ভিতরে-ভিতরে পালানোর অপরাধবোধটা কুরে খাচ্ছিল। পরবর্তী জীবনে যখন চাকরি নিয়ে রাঁচি গেলেন তখন সেখানে নিজে উদ্যোগী হয়ে শুরু করলেন রক্তদান শিবির।
স্কাইপে ধরা হয়েছিল আমেরিকা-প্রবাসী সঞ্চিতা দেব-কে। হেসে গড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘টিঙটিঙে চেহারা ছিল। ওজন পঁয়তাল্লিশ কেজি না-হলে আবার রক্ত দেওয়া যাবে না। অগত্যা শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে দু’টো পেপার-ওয়েট বেঁধে চলে গেলাম!’

যাদবপুরের ১৯৬২-র রক্তদান শিবির। তত্ত্বাবধান করছেন ত্রিগুণা সেন।
১৯৬২ সালের অগস্ট মাস। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের একাংশ ঠিক করলেন, বড়সড় সংগঠিত শিবির হবে। লিফলেট বিলি হল ক্লাসে-ক্লাসে। দাতাদের উদ্বুদ্ধ করতে সচেতনতা শিবির হল। বিনা পয়সায় গান গাইলেন দেবব্রত বিশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধুনালুপ্ত ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রক্তদান শিবিরে ৪-১৬ অগস্ট টানা ১৩ দিনে মোট ৩০১ জন রক্ত দিলেন।
তার পর গত পঞ্চাশ বছরে পশ্চিমবঙ্গ স্বেচ্ছা রক্তদানে নিঃসন্দেহে এগিয়েছে। অনেক বেশি শিবির, অনেক সচেতনতা, অনেক বেশি রক্তদাতা। তা-ও কি কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছতে পেরেছি আমরা? পৃথিবীতে এমন ৬২টা দেশ আছে যেখানে সারা বছর রক্তের পুরো প্রয়োজনটাই মেটে স্বেচ্ছা রক্তদানে সংগৃহীত রক্তে। আমরা এখনও সেটা করতে পারলাম কই? পারলে, অগস্ট আর জানুয়ারিতে শিবিরের বন্যা বইবে আর এপ্রিল-মে মাস গরম বলে শিবির হবে না, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পুজোর মাস বলে রক্তদান শিবির তাকে তোলা থাকবে কেন? স্বেচ্ছা রক্তদানের তাগিদ তো মরসুমি হতে পারে না!
রক্তদান শিবিরের ব্যাপারটা এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ায় প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে গিয়েছে জনসংযোগ। এপ্রিল-মে মাসে পরীক্ষা বেশি, মাইকের উপর নিষেধাজ্ঞা, তাই জনসংযোগ ধাক্কা খায়। আর পুজোর মরসুমে খোদ পুজোটাই তো ফাটাফাটি সংযোগ মাধ্যম। পুজো সামলে আবার যখন নেতারা শিবিরে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পাবেন, রক্তদান শিবির হবে।
১৯৮৪ সাল থেকে রক্তদান শিবির করছেন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বললেন, ‘আমি এখন বছরে তিনটে ক্যাম্প করি। এর মাধ্যমে জনসংযোগ হয় অস্বীকার করছি না। পুজোর মাসে ক্যাম্প করি না। কারণ, ওই সময় পাড়ায় আমার নিজের পুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকি।’ ১৭ বছর ৪ মাসে বয়স লুকিয়ে রক্তদান শুরু করেছিলেন বামফ্রন্ট নেতা বিমান বসু। তাঁর দল পুজোর সময় অনেক মণ্ডপের সামনে বুকস্টল করে। কিন্তু কেন কোনও রক্তদান শিবির করে না? বিমানবাবুর উত্তর, ‘পুজোর সময় আমরা আলিমুদ্দিনে রক্তদান শিবির করি।’ কিন্তু ক’টা লোক সেটা জানতে পারেন? শহর উজিয়ে আলিমুদ্দিনে রক্ত দিতে যাবেনই বা ক’জন?
পুজো-পুজো আবহে সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কও শিবিরে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায় না। যতটুকু শিবির পাওয়া যায় সেটাও বহু সরকারি ব্লাডব্যাঙ্ক প্রত্যাখ্যান করে। কারণ? সেই ফাটা রেকর্ড‘লোক নেই, পরিকাঠামো নেই। পুজোর সময় আরও স্কেলিটন স্টাফ। তাই শিবির কমাতে হবে।’ কেন বছরের পর বছর এই ‘নেই’ দূর করার কোনও তাগিদ নেই সরকারের? কবে শিবিরে যাওয়া-আসার পর্যাপ্ত গাড়ি আসবে? সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে যখন এতই কর্মীর অভাব তখন এ হেন ইমার্জেন্সি সার্ভিসের কর্মীদের ‘একটা নাইট ডিউটির জন্য একটা ছুটি’র নিয়ম কেন?
এ বছর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সপ্তমী থেকে দশমী একটাও শিবির করেনি, আর জি কর হাসপাতাল শুধু সপ্তমীর দিন একটা শিবির করেছে যেখানে মাত্র ৪৫ জন রক্ত দিয়েছেন। এসএসকেএম একটিও শিবির করেনি, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ শুধু সপ্তমীতে একটি শিবির করেছে, নীলরতন সরকার হাসপাতাল সপ্তমীতে একটা আর দশমীতে একটা শিবির করেছে, মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাডব্যাঙ্ক সপ্তমী থেকে দশমী মোট ৭টি শিবির করেছে কিন্তু কোনও শিবিরে রক্তদাতার সংখ্যা ৮০ পার হয়নি।
ইংল্যান্ডের অনেক ব্লাডব্যাঙ্কে ড্রাইভাররাই রক্তদান শিবিরের করণিকের দায়িত্ব পালন করেন। আলাদা কর্মী লাগে না। কানাডায় রক্তদান শিবিরে ডাক্তারেরা যান না। নার্সরাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেন। তা ছাড়া, হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদের চিকিৎসকেরা কি শিবিরে দাতাদের প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষাটুকু করে দিতে পারেন না? এতে তো ডাক্তারের অভাব অনেকটা মেটানো যায়। এই সব নিয়ে ভাবনাচিন্তা কেন ৫০ বছরেও শেষ হল না?
উৎসব মানেই এখনও কেন রক্তশূন্যতা?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.