শেষ পর্যন্ত আজমল কসাবের ফাঁসি হইয়া গেল। ২৬/১১-র মুম্বই হামলা অপকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িতদের মধ্যে কসাবই ছিল একমাত্র জীবিত জেহাদি। ১৬৮ জন নিরীহ মানুষের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত অবশিষ্টরা রণাঙ্গনেই নিহত হয়। জীবন্ত ধরা-পড়া কসাবের বিচারপ্রক্রিয়া সমাপন এবং দণ্ড কার্যকর করিতে দীর্ঘ চার বছর লাগিয়া গেল, তাহার কারণ সমগ্র প্রক্রিয়াটিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিধি শিরোধার্য করিয়া নিষ্পন্ন করা হয়। অনেকেরই স্মরণ থাকিবে, বিচার-প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্বে কসাবের জন্য কোনও আইনজীবীই খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছিল না, যেহেতু স্বেচ্ছায় কোনও আইনজীবীই এতগুলি নিরীহ মানুষের খুনের দায়ে অভিযুক্তের পক্ষ সমর্থনে আগাইয়া আসিতে দ্বিধামুক্ত হইতে পারেন নাই। এই সমস্যা সমাধানেও কিছু মূল্যবান সময় ব্যয় হইয়া যায়। তাহার পর নিম্ন আদালতের বিচার ও রায়, তাহার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন ও পুনর্বিচার, সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরেও কসাবের তরফে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন পৌঁছাইয়া দেওয়া হয়। সমগ্র প্রক্রিয়াটি সুচারু রূপে সাঙ্গ করিতে এইটুকু সময় তো লাগিবেই।
রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ হওয়া প্রাণভিক্ষার আবেদন সাধারণত দীর্ঘ কাল পড়িয়া থাকে। কখনও রাষ্ট্রপতি আবেদনটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য ফিরাইয়াও দেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনও বিবেচনাবোধকে নাক গলাইতে দেন নাই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অক্ষরে-অক্ষরে পালন করিয়া তিনি মৃত্যুদণ্ডাদেশে স্বাক্ষর করিয়াছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিধি-মাফিক তাঁহার যাহা করণীয়, ঠিক সেটুকুই করিয়াছেন, নিজ এক্তিয়ারের সীমানার বাহিরে পা দেন নাই। এই জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অভিনন্দন প্রাপ্য। তিনি বিচার ও দণ্ড কার্যকর করিবার প্রক্রিয়াটিতে কোনও বাধা বা বিঘ্ন সৃষ্টি করেন নাই, তাহাকে মসৃণ ভাবে অগ্রসর হইতে দিয়াছেন। ফলে আইনের শাসন বলবৎ হওয়ার প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু থাকিয়াছে। আইনের শাসন দাবি করে, আততায়ী যাঁহাদের হত্যা করে, তাঁহাদের প্রতি ন্যায়বিচার করিতে গেলে হত্যাকারীকে কঠোর দণ্ড বুঝাইয়া দিতে হইবে। আজমল কসাবের অপরাধ মার্জনার যোগ্য ছিল না। শীর্ষ আদালত তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইয়া দিবার পর এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাও তাহাতে সিলমোহর লাগাইয়া দিবার পর রাষ্ট্রপতির তরফে অন্য রকম ভাবার কোনও অবকাশ ছিল না।
আইনের শাসন ভারতীয় গণতন্ত্রের নিহিত শক্তি। এশিয়ার অপরাপর গণতন্ত্রের তুলনায় তাহার উৎকর্ষেরও অভিজ্ঞান এই আইনের শাসন। ঘৃণ্যতম অপরাধীকেও গণতন্ত্র আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়। ভারতও কসাবকে সেই সুযোগ দিয়াছে, অনেক ক্ষেত্রেই জনরোষের আশঙ্কাকে অগ্রাহ্য করিয়াই। গণতন্ত্রের আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিতে গিয়াই কসাবকে জীবন্ত গ্রেফতার করিতে হয়, তাহার জন্য আদালতে সওয়াল করিতে অনিচ্ছুক আইনজীবীদেরও বাধ্য করিতে হয়, বিপুল সরকারি খরচে কসাবের নিরাপত্তা ও বিচারপ্রক্রিয়া চালাইতে হয়, পাকিস্তানের বক্তব্য ও অবস্থানের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়। কসাবের সঙ্গী জেহাদিরাও যে কসাবের মতোই পাকিস্তান হইতেই প্রশিক্ষণ, রসদ, অর্থ ও নির্দেশ লইয়া কাজ করিয়াছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হইয়া নয়াদিল্লির পক্ষে ইসলামাবাদের মনোভাব জানা আবশ্যক ছিল। কিন্তু পাকিস্তান জঙ্গি হামলার সব ঘটনা হইতে হাত ধুইয়া ফেলিতে উদ্গ্রীব হওয়ায় ভারতকে কসাবের বিচারে মনোনিবেশ করিতেই হয়। ফাঁসির আদেশ লইয়া যাহাতে জনসমাজে কোনও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়, সে জন্য নিঃশব্দে জেলখানার ভিতরেই নির্দিষ্ট দিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিলেও পাকিস্তানকে সে বিষয়ে অগ্রিম অবহিত করা হয় এবং কসাবের দেহ লইবার বিকল্পও খোলা রাখা হয়। পাকিস্তান নিজের কূটনৈতিক অস্বস্তি লুকাইতে এ বিষয়ে আপন অনাগ্রহ দেখাইলেও ভারত কিন্তু কর্তব্য, পদ্ধতি, রীতি পালনে কোনও ফাঁক রাখে নাই। খুঁটিনাটি বিষয়েও আইনের শাসন বলবৎ করিবার এই প্রবণতাই ভারতীয় গণতন্ত্রের উৎকর্ষ চিহ্নিত করিয়াছে। |