|
|
|
|
কঠোর সিদ্ধান্তে বিজেপিকে কোণঠাসা করল কংগ্রেস |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
সকাল আটটা। গোটা দেশকে চমকে দিয়ে খবর ছড়াল, ২৬/১১-র একমাত্র জীবিত জঙ্গি মহম্মদ আজমল আমির কসাবকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে পুণের ইয়েরওয়াডা জেলে। আর তৎক্ষণাৎ ফাঁসির ‘সময়’ ঘিরে জল্পনা শুরু হয়ে গেল রাজনীতির কারবারিদের মধ্যে।
আগামিকাল থেকে শুরু হচ্ছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুমকির জেরে সরকার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই ঠিকই, কিন্তু তারা যে বেশ চাপে তাতেও সন্দেহ নেই। কারণ, খাতায়-কলমে সরকার সংখ্যালঘু। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে বিরোধীরা। এ নিয়ে লোকসভায় ভোটাভুটি-সহ আলোচনা চেয়ে নোটিস দিয়েছে বামেরা। এই পরিস্থিতিতে কসাবের ফাঁসির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ কড়া হাতে হাল ধরার বার্তা দিলেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসের যে ধারা গত কয়েক দশক ধরে চলছে, তাকে কঠোর বার্তা দিতে কসাবের ফাঁসি অনিবার্যই ছিল। কিন্তু দিল্লির অনেক রাজনীতিকেরই মতে, বিজেপি যখন নেতৃত্বের সঙ্কটে জেরবার, তখন গুজরাত নির্বাচনের মুখে, লোকসভা নির্বাচনের দেড় বছর আগে সনিয়া-মনমোহন এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকেও বোঝাতে চাইলেন যে, তাঁরা নেতৃত্ব দিতে জানেন। আর সেই কাজ করার জন্য তাঁরা থাবা বসালেন বিজেপি-র খাসতালুক জাতীয়তাবাদে।
মাত্র ছ’মাস আগে কার্যত কোমায় চলে যাওয়া একটা সরকারের এই উত্থান রাজনীতির কারবারিদের চোখে এক কথায় চমকপ্রদ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগের আর পরের মনমোহন সরকারের মধ্যে যেন আকাশপাতাল তফাত। গোড়ায় আর্থিক সংস্কারের কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নীতিপঙ্গুত্ব দশা কাটানো। তার পর মন্ত্রিসভায় রদবদল করে সরকারের ভাবমূর্তি শোধরানোর চেষ্টা। আর আজ কসাবের ফাঁসি। বিজেপি-কে মোক্ষম চাপে ফেলে কংগ্রেস বুঝিয়ে দিল, জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তারা প্রধান বিরোধী দলের থেকে এক কদমও পিছিয়ে নেই। |
|
সেই তাজ হোটেল। সামনে মোতায়েন পুলিশ। ছবি: উৎপল সরকার |
এই রাজনৈতিক কৌশলের ফসল ঘরে তুলতে এ বার কী করতে পারে কংগ্রেস? আপাতত এটাই রাজধানীর রাজনীতিকদের অন্যতম চর্চার বিষয়। অনেকের মতে, জানুয়ারির চিন্তন বৈঠক থেকেই লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দেবে কংগ্রেস। তার পর ফেব্রুয়ারিতে জনমোহিনী বাজেট করে আচমকা ভোট ঘোষণা করে দিতে পারে তারা। কংগ্রেসের এক প্রথম সারির এক নেতা আজ বলেন, শেষ পর্যন্ত সনিয়া-মনমোহন ভোট এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেবেন কিনা জানা নেই। তবে এটুকু পরিষ্কার যে, লোকসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে একটি চিত্রনাট্য ধরেই এগোচ্ছেন কংগ্রেস সভানেত্রী।
যে চিত্রনাট্যের কসাব-অঙ্ক উন্মোচনের পরে দৃশ্যতই অসহায় বিজেপি। ২০০৮ সালে মুম্বই সন্ত্রাসের পরে কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলে প্রচারে নেমেছিল তারা। সেই প্রচার আজ পুরোপুরি ভোঁতা হয়ে গেল। বিজেপি-র পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে থেকে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম আজ বলেছেন, “মুম্বইয়ে ঘৃণ্য সন্ত্রাসের ঘটনার আজ শেষ বিচার হল। মৃতদের পরিবারের অন্তত এটুকু শান্তি হল যে, দোষীদের শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়েছে।”
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, মুম্বই হানার চার বছর পূর্তির আগেই কসাবকে শাস্তি দেওয়া গিয়েছে। বিজেপি কিন্তু ২০০০ সালে সংসদ হানার পরে চার বছর ক্ষমতায় থাকলেও আফজল গুরুকে শাস্তি দিতে পারেনি। অর্থাৎ, কসাবের ফাঁসির পরে বিজেপি-র হাতে অস্ত্র বলতে রইল যে আফজল গুরু, তা-ও কেড়ে নিতে চাইছে কংগ্রেস।
সেই চেষ্টা ঠেকাতে আজ আফজল গুরু নিয়েই সরব হয়েছেন বিজেপি নেতারা। যাঁদের মধ্যে অন্যতম গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সরকারের সমালোচনা করে তাঁরা বলেছেন, সংসদ হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝোলাতে কেন দ্বিধা করছে সরকার?
কেন এখনও সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতি করছে! যার জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ বলেন, “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ লড়াই প্রয়োজন, তখন বিজেপি রাজনীতি করছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য এ-ও জানিয়েছেন যে, আফজল গুরুর ফাঁসির ব্যাপারেও শীঘ্রই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর সুশীল শিন্দের বক্তব্য, বিষয়টি এখন রাষ্ট্রপতির বিবেচনাধীন। চিদম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন বার বার যুক্তি দিয়েছিলেন যে, প্রাণভিক্ষার আবেদনের ক্রমানুসারে একটি একটি করে মামলার নিষ্পত্তি হবে। অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা-প্রাপ্তদের তালিকায় আফজলের আগে যাদের নাম রয়েছে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আফজলের ফাঁসি হবে কি হবে না। কিন্তু কসাবের ফাঁসি আজ দেখিয়ে দিল যে এই রকম কোনও ক্রম মেনে চলার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
তাই বলে আফজলের যে এখনই ফাঁসি হয়ে যাবে, সেটাও মনে করছেন না কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। ঘরোয়া আলোচনায় তাঁদের অনেকেই আজ বলেন, কসাব আর আফজলকে এক করে দেখা ঠিক নয়। কসাব পাকিস্তানের লোক। বহিঃশত্রু। আর আফজল গুরু ভারতের নাগরিক, কাশ্মীরের বাসিন্দা। তাকে আদালত এক বার মুক্তি দেওয়ার পরে ফের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তার শাস্তি মকুব করার জন্য আর্জি জানাচ্ছে গোটা কাশ্মীর। এই স্পর্শকাতরতা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার সঙ্গে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জও। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, বিজেপি সব জেনেও শুধু শুধু রাজনীতি করছে। যে রাজনীতির ফণা কিছু দিনের জন্য হলেও আজ অনেকটাই নুইয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন সনিয়া-মনমোহন।
|
|
|
|
|
|
|