আশার আলো তৈরি হচ্ছিল কয়েক দিন আগে থেকেই। কিন্তু না আঁচানো অবধি যে কোনও কিছুরই বিশ্বাস নেই, ঠিক দেড় বছর আগে সে অভিজ্ঞতা পূর্বস্থলীর মানুষের হাতে-কলমে হয়েছিল। তাই সকলেই ছিলেন আশা-আশঙ্কার দোলাচলে।
বুধবার সকালে খবর যখন এল, উৎসব-অনুষ্ঠানে মাততে চেয়েছিলেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। কলকাতা থেকে ফোনে অবশ্য কড়া নির্দেশ এল, কোনও রকম বাড়াবাড়ি করা যাবে না। পূর্বস্থলীর নানা এলাকায় তৃণমূলের লোকজন অবশ্য সেই নির্দেশ পুরোপুরি মানলেন না। দুপুরে টিভির পর্দায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে স্বপন দেবনাথের শপথগ্রহণের ছবি ভেসে উঠতেই হাততালির ঝড়। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে গোলাপ বিতরণ, মিষ্টি বিলি, আবির খেলায় মাতলেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। আশঙ্কার মেঘ কাটিয়ে দ্বিতীয় বার মন্ত্রী পেল পূর্বস্থলী।
|
২০১১ সালের ২০ মে। রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে নতুন মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল সে দিন। পূর্বস্থলীর হেমায়েতপুর মোড়ে তৃণমূল অফিসের সামনে বাঁধা হয়েছিল মণ্ডপ। এসেছিল বিশাল টিভি। স্বপন দেবনাথ মন্ত্রী হবেন, এই আশায় বাজনা, আবির, মিষ্টি নিয়ে তৈরি ছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। তবে বেলা বাড়তেই খবর আসে, এলাকার বিধায়ক মন্ত্রী হচ্ছেন না। আনন্দ মাটি হয়ে যায়। দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে ভিড় পাতলা হয়। এলাকার কয়েক জন তৃণমূল নেতা তখন মন্তব্য করেছিলেন, “সুবিচার হল না।”
মন্ত্রিসভায় কয়েকটি নতুন মুখ আসছে, অক্টোবরে এ খবর চাউর হওয়ার পর থেকেই ফের আশায় বুক বাঁধতে থাকেন পূর্বস্থলীর মানুষজন। তবে আগের অভিজ্ঞতার কারণে আশঙ্কাও ছিল। সাবধানী ছিলেন স্বপনবাবুও। সাধারণ মানুষ এবং দলের লোকজন মন্ত্রিত্ব নিয়ে কিছু জানতে চাইলে মুখ খুলছিলেন না। এমনকী মঙ্গলবার রাতেও ফোনে তিনি বলেন, “আমাকে কাল দুপুরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যেতে বলা হয়েছে। এর বেশি কিছু জানা নেই।” |
টিভিতে শপথগ্রহণ দেখতে ভিড়। বুধবারের নিজস্ব চিত্র। |
এ দিন অবশ্য শপথগ্রহণের পরে সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, উত্তর শ্রীরামপুর, দক্ষিণ শ্রীরামপুর-সহ নানা এলাকায় উচ্ছ্বাস-উল্লাসে মাতেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। শ্রীরামপুর এলাকার এক নেতার কথায়, “২০১১-এর ২০ মে আবির এনেও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আজ অবশ্য আর ফিরতে হল না।” শ্রীরামপুর পঞ্চায়েত এলাকার অনেক জায়গাতেই এ দিন ডগর, তাসা-সহ নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মানুষজনকে রাস্তায় নামতে দেখা গিয়েছে। বিদ্যানগরে স্বপনবাবুর বাড়িতেও বাজনা নিয়ে হাজির হন অনেকে। তাঁর মা লাবণ্যপ্রভাদেবী বলেন, “ছোট থেকেই ওর মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা রয়েছে। |
স্বপনবাবুর মায়ের পায়ে আবির তৃণমূল কর্মীদের। বুধবারের নিজস্ব চিত্র। |
আশা করি, মন্ত্রী হয়ে মানুষের সেবা করবে।” স্বপনবাবুর ভাই প্রদ্যুৎবাবু বলেন, “ভোটে দাঁড়িয়ে দাদা অনেক বার হেরেছেন। মনের জোর না থাকলে এত দূর পৌঁছনো সম্ভব হত না।” জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস নাগ বলেন, “হারের হতাশা কখনও তাঁর উপরে চেপে বসেনি। সমর্থকদের মধ্যেও তার কোনও রেশ পড়তে দিতেন না।”
পূর্বস্থলীর এক তাঁতশিল্পী মান্তু বসাক বলেন, “এলাকায় তাঁতশিল্পের দুর্দশা বহু দিনের। আশা করি এ বার পরিস্থিতি পাল্টাবে।” কালনার সিপিএম নেতা বীরেন ঘোষের বক্তব্য, “এক সময়ে স্বপনবাবু প্রচারে বলতেন, বামেরা কিছু করেনি। এ বার তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন। কতটা সফল হবেন, ভবিষ্যতই বলবে।” কালনার কংগ্রেস নেতা লক্ষ্মণ রায় বলেন, “মহকুমার এক বিধায়ক মন্ত্রিত্ব পাওয়ায় এলাকার উন্নয়ন হবে বলে আশা করছি।”
তবে স্বপনবাবু পূর্ণমন্ত্রী না হওয়ায় খেদ থেকে যাচ্ছে এলাকার তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একাংশের। এক তৃণমূল কর্মীর কথায়, “যখন শুনলাম স্বপনদা ক্ষুদ্রশিল্প, বস্ত্র এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন, খানিকটা হলেও হতাশ হয়েছি।” স্বপনবাবুর অবশ্য এ সব নিয়ে হেলদোল নেই। এ দিন সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “যে দায়িত্ব পাচ্ছি সেখানে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বলবেন, সেই অনুযায়ী কাজ করব।” |
কালনার যত মন্ত্রী |
• ১৯৬৭ কালনা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের মন্ত্রী হন সিপিআইয়ের হরেকৃষ্ণ কোঙার।
• ১৯৬৯ ফের মন্ত্রী হন হরেকৃষ্ণ কোঙার।
• ১৯৮২ নাদনঘাট থেকে জিতে আইনমন্ত্রী হন সিপিএমের মনসুর হবিবুল্লাহ।
• ১৯৮৭-২০০৪ নানা দফায় বয়স্ক শিক্ষা এবং পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কালনার সিপিএম বিধায়ক অঞ্জু কর।
• ১৯৫৭ কালনার টোলা গ্রামের বাসিন্দা, কংগ্রেসের আব্দুস সাত্তার শ্রমমন্ত্রী হন। তিনি অবশ্য জেতেন কেতুগ্রাম কেন্দ্র থেকে। |
|
আরোহণের পথে |
•১৯৬৯ নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়তে ছাত্র পরিষদে।
• ১৯৭১-৭৩ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কংগ্রেস নেতা নুরুল ইসলামের হাত ধরে জেলা রাজনীতিতে প্রবেশ। ইতিমধ্যে প্রথমে এমকম, পরে এলএলবি পাশ করেন। পূর্বস্থলীর জাহান্নগর কুমারানন্দ উচ্চ বিদ্যালয় ও কালনা কলেজে শিক্ষকতাও করেন কিছু দিন। পরে পেশায় আইনজীবী।
• ১৯৮৭ নাদনঘাট বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী হন। সিপিএম প্রার্থী মনসুর হবিবুল্লাহের কাছে হার।
• ১৯৯১ নাদনঘাট বিধানসভায় কংগ্রেসের প্রার্থী। সিপিএমের বীরেন ঘোষের কাছে হার।
• ১৯৯৬ নাদনঘাট থেকে ফের কংগ্রেসের প্রার্থী। সিপিএমের বীরেন ঘোষের কাছে হার।
• ১৯৯৮ তৃণমূলে যোগ। সে বছর কাটোয়া লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হন। সিপিএমের মেহবুব জায়দির কাছে হার।
• ২০০১ নাদনঘাট বিধানসভায় তৃণমূলের প্রার্থী। সিপিএমের রতন দাসের কাছে হার।
• ২০০৬ নাদনঘাট থেকে তৃণমূলের প্রার্থী। সিপিএমের রতন দাসকে হারিয়ে প্রথম বার বিধায়ক।
• ২০১১ পূর্বস্থলী দক্ষিণ থেকে তৃণমূলের প্রার্থী। হারান সিপিএমের আলেয়া বেগমকে। |
|