জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
ক’দিন আগেও সমস্যা ছিল না। দিল্লি থেকে দিব্যি আসছিল বিবিধ উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা। কিন্তু ছবিটা অকস্মাৎ বদলে গিয়েছে। ইদানীং কিছুটা যেন শ্লথ হয়ে পড়েছে বরাদ্দপ্রাপ্তির গতি।
এবং এ জন্য কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের দিকে আঙুল তুলছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। তাদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কেন্দ্রের ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর থেকেই কখনও চটজলদি খরচের হিসেব চেয়ে, কখনও বা শর্ত জুড়ে প্রাপ্য আটকে রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। উন্নয়নের চেয়ে রাজনীতিকে বড় করে দেখার এ হেন অভিযোগ কেন্দ্র অবশ্য মানছে না। দিল্লির কর্তাদের দাবি, এ সবই রুটিন ব্যাপার, নিয়মের বাইরে কিছু করা হচ্ছে না।
সময় মতো বরাদ্দ খরচ কিংবা হিসেব পেশের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ড কি খুব ভাল?
সেটা যে নয়, রাজ্যের একাধিক কর্তা তা মেনে নিচ্ছেন। তবু উন্নয়নের অর্থ হাতে পেতে এত দিন বিশেষ অসুবিধে হয়নি বলে ওঁদের দাবি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র-মমতা জোটবন্ধন যে বড় অনুঘটকের ভূমিকা নিচ্ছিল, তা-ও তাঁরা ঠারেঠোরে স্বীকার করছেন। ওঁদের অনেকের মতে, রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে যাওয়ায় কেন্দ্রের মনোভাবও বদলেছে। চাওয়ামাত্র টাকা পাওয়ার মতো জায়গায় পশ্চিমবঙ্গ এই মুহূর্তে নেই। এ নিয়ে সরকারি ভাবে প্রতিবাদ জানানোরও অবকাশ নেই। রাজ্যের এক শীর্ষস্থানীয় আমলা বলেন, “এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাজনীতির অঙ্কের সুবাদে কিছু রাজ্য দিল্লির কাছে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। ঠিক সময়ে হিসেব না-দিলেও টাকা পেতে অসুবিধে হয় না। আবার চাপ সৃষ্টির খাতিরে কিছু রাজ্যকে হিসেব দাখিলের তাগাদা দেওয়া হয়।”
|
আটক বরাদ্দ |
*অঙ্ক টাকায় |
একশো দিনের কাজ |
৬৫০ কোটি |
কৃষি বিকাশ যোজনা |
২৩০ কোটি |
জেএনএনআরইউএম |
১০০ কোটি |
মাওবাদী দমন |
১৫ কোটি |
সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন |
২০ কোটি |
ইন্দিরা আবাস |
৪০০ কোটি |
|
আপাতত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটছে বলে প্রশাসনের একাধিক কর্তার দাবি। ওঁদের এক জনের কথায়, “খরচের হিসেব অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) চাওয়াটাই দস্তুর। এখন দেখছি, সেপ্টেম্বর থেকেই দিল্লি হিসেব চাইছে! পরের কিস্তি আটকে দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে!” মহাকরণের খবর: তৃণমূল ইউপিএ ছাড়ার পরে, গত ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কৃষি-সচিব রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখে রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (আরকেভিওয়াই)-র টাকা খরচের হিসেব চেয়েছেন। চিঠির বক্তব্য: ‘ওই খাতে পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ প্রায় ৪৬৫ কোটির মধ্যে ২৩৪ কোটি পাঠানো হয়েছে। তার হিসেব দাখিল না-হলে পরের কিস্তি ছাড়া যাবে না।’
প্রথম কিস্তি পৌঁছাতেই এ ভাবে খরচের হিসেব চাওয়াটা রাজ্যের আধিকারিকদের কাছে অপ্রত্যাশিত ঠেকছে। “টাকা পেলে হিসেব দিতেই হবে। কিন্তু এই তো সবে টাকা পেলাম! প্রকল্পটি দ্রুত রূপায়ণের চেষ্টা হচ্ছে।” বলেন কৃষি-সচিব সুব্রত বিশ্বাস। উল্লেখ্য, এ বছরে আরকেভিওয়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য যখন বরাদ্দ স্থির হয়, তখন কেন্দ্রে তৃণমূলের জোট বর্তমান। রাজ্যকে তখন বাড়তি দেড়শো কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। রাজনীতির জটে যার প্রাপ্তিভাগ্য এখন অনিশ্চিত বলে মহাকরণের কর্তাদের অনেকে মনে করছেন।
খোদ মমতার হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতরের কাজ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিশেষ সচিব (অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা) অজয় চাড্ডা মহাকরণে চিঠি পাঠিয়ে বলেছেন, মাওবাদী মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গে ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অ্যান্ড অ্যান্টি টেররিস্ট স্কুল’ নির্মাণে কেন্দ্র দেড়শো কোটি টাকা দিলেও প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে অন্ধকারে। দেড়শো কোটির হিসেব না-দিলে আর টাকা মিলবে না। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে উগ্রপন্থা মোকাবিলার প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি গড়ে তোলার তোড়জোড় চলছে। একই ভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব (নকশাল দমন) এম গণপতি সোমবার মহাকরণে চিঠি দিয়ে গত তিন বছরের হিসেব তলব করেছেন। মহাকরণের তথ্য: গত তিন বছরে মাওবাদী দমনে রাজ্য ২১ কোটি টাকা পেলেও হিসেব দাখিল হয়েছে মাত্র ৬ কোটির। এমনকী, ২০০৮-০৯ সালের টাকাও পড়ে রয়েছে, যা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছে সিএজি। গণপতির চিঠিতে সে প্রসঙ্গও রয়েছে।
তাই মাওবাদী প্রতিরোধে বাকি বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেছে। ছন্দপতন জেএনএনআরইউএমেও। নগরোন্নয়ন সংক্রান্ত পরিকল্পনাটিতে গুচ্ছ প্রকল্প মঞ্জুর করার পরেও কেন্দ্র প্রথম কিস্তির প্রায় একশো কোটি টাকা ছাড়েনি। কেএমডিএ-র চিফ একজিকিউটিভ অফিসার বিবেক ভরদ্বাজের কথায়, “গত ক’মাস ধরে শুনছি, নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অর্থ মঞ্জুরি কমিটি টাকা দিয়ে দেবে। এখনও পাইনি।” জোটে থাকাকালীন সীমান্ত এলাকা উন্নয়নে (বিএডিপি) বরাদ্দ ১৬০ কোটির মধ্যে ১২০ কোটি রাজ্যকে দিয়ে দিয়েছিল দিল্লি। কিন্তু বিগত অর্থবর্ষ পর্যন্ত যাবতীয় প্রকল্পের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট তলব করা হয়েছে ক’দিন আগে। সার্টিফিকেট দিতে না-পারায় বিএডিপি’র ২০ কোটি রাজ্যের হাতছাড়া হতে চলেছে।
এতেই শেষ নয়। ‘ভাল কাজের’ জন্য সদ্য কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রীর প্রশংসা কুড়ানো পঞ্চায়েত দফতরও কয়েকটি প্রকল্পে বরাদ্দ আদায়ে বেগ পাচ্ছে। একশো দিনের কাজ বাবদ ষষ্ঠীর দিন এসেছিল ছ’শো কোটি। তা ফুরিয়ে যাওয়ায় আরও সাড়ে ছ’শো কোটি চেয়ে দিল্লিতে দরবার করেছে রাজ্য। এখনও মেলেনি। প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার দিব্যেন্দু সরকারের অনুমান, “প্রয়োজন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে টাকা আসাটা বোধহয় একটু ধাক্কা খেয়েছে।” উপরন্তু ইন্দিরা আবাস যোজনার দ্বিতীয় কিস্তির বরাদ্দ একটা জেলাও পায়নি। কেন্দ্রের যুক্তি, প্রথম কিস্তির টাকাই খরচ হয়নি। “কিন্তু ছ’টা জেলা তো প্রথম কিস্তি খরচ করে ফেলেছে! তারা কেন পাচ্ছে না?” পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন মহাকরণের কর্তারা।
তবে প্রশ্নটা রাজ্যের ঘরোয়া প্রশাসনিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ। এ নিয়ে সরাসরি দিল্লির কাছে প্রতিবাদ জানানোর অস্ত্র কর্তাদের হাতে নেই। কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাসমুন্সি জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের কাছে যাবতীয় কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা খরচের হিসেব চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। “মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ প্যাকেজ দাবি করছেন। তার আগে আমরা দেখে নিতে চাই, আগের টাকায় কাজ ঠিকঠাক হয়েছে কি না।” বলেন দীপাদেবী। এই ‘চাওয়া’ নিয়ে সরকারি ভাবে আপত্তি তোলা যে কঠিন, তা স্বীকার করে রাজ্যের এক শীর্ষ আমলার মন্তব্য, “কেন্দ্রের আচরণের পিছনে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বা চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলেও আমাদের কিছু বলার নেই। কারণ, খরচের হিসেব চাওয়াটা নিয়ম-বহির্ভূত কিছু নয়।”
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “পঞ্চায়েত দফতর চালাতে দিল্লির সহযোগিতা পাচ্ছি!” কিছু প্রকল্পে যে টাকা আটকে থাকছে? “ছোটখাটো সমস্যা থাকলে সে সব আলোচনায় মিটিয়ে নিতে হয়।” দাওয়াই সুব্রতবাবুর।
|