|
|
|
|
রং-তুলিতেই মনের কথা বলে শিবম |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
ছোট থেকেই মুখে কথা বলতে না পারলেও রং-তুলিতেই কথা বলত ছোট্ট শিবম। হাতের কাছে সাদা কাগজ পেলেই ইচ্ছেমতো নানা রঙের আঁকিবুকিতে ভরিয়ে তুলত। ছেলের মর্জি দেখে তিন বছর বয়সেই এক আঁকা শেখার কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। মনে জোর ছিল, ও নিশ্চয় পারবে। সেই জোরেই আজ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনের পথে এগিয়ে চলছে মেদিনীপুরের শিবম পাণ্ডব। ছবি এঁকেই ‘ক্রিয়েটিভ চাইল্ড’ পুরস্কার পাচ্ছে সে। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেবেন রাজ্যপাল এম কে নারায়নন।
ছেলের গর্বে চোখে জল মা সাগরিকা পাণ্ডবেরও। বললেন, “মনে জোর ছিল। জানতাম চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। আমরাও পারব ছেলেকে মানুষ করতে।” আর বাবা তপনবাবু বলেন, “ছোট থেকেই ওকে নিয়ে চিন্তা ছিল। তবে হাল ছাড়িনি। এমন পুরস্কার আমাদের মনের জোর আরও বাড়াবে।” |
|
বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে খুদে শিল্পী। —নিজস্ব চিত্র। |
শিবমদের বাড়ি মেদিনীপুর শহরের পাটনাবাজারে। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা। বাবা তপনবাবুর গহনার দোকান রয়েছে। মা সাগরিকাদেবী গৃহবধূ। শিবম এখন ৬ বছরের। শহরেরই এক স্কুলে কেজি ২তে পড়ে। আঁকার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও ভালো। কেজি ১ এর বার্ষিক পরীক্ষায় ১৫তম স্থান পেয়েছে সে। তবে এমন ছেলেকে আর পাঁচটা ‘সাধারণ’ শিশুর সঙ্গে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন বাবা-মা। তপনবাবুর কথায়, “কানে মেশিন পরানো কম শুনতে পাওয়া ছেলেকে স্কুল ভর্তি নিতে চায়নি। অনেক অনুরোধের পর ভর্তি নেওয়া হয়েছে।” ওর বাড়ির লোকই জানালেন, শিবমের বয়স যখন ৭-৮ মাস তখন সে বা-বা, মা-মা বলত। বয়স যখন ১ বছর হল, তখনও একই রকম। নতুন কথা নেই। চিন্তা শুরু তখন থেকেই। সঙ্গে উদ্বেগ। সাগরিকাদেবী বলেন, “ওকে মেদিনীপুরের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ও সব ঠিকঠাক শুনতে পায়। ভাবনার কিছু নেই। তবে, মন মানছিল না। কয়েক মাস পর অন্য এক ডাক্তার দেখে বলেন, ও কানে কম শোনে। এরপরই ভেলোরে নিয়ে গিয়ে ওর চিকিৎসা করানো হয়।” ডাক্তারের পরামর্শে শিবমের দুই কানে মেশিন লাগানো হয়। এখন দিনের অধিকাংশ সময়ই হিয়ারিং এইড লাগিয়ে রাখতে হয়। মেশিন ছাড়া প্রায় কিছুই শুনতে পায় না সে। এরপর দুর্গাপুরের ‘সাহস’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তপনবাবুরা। এখানে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ (স্পিচ থেরাপি) দেওয়া হয়। তপনবাবু বলেন, “ওই সংস্থার কাছে শিখেছি, কানে শুনতে না পেলেও কথা বলা যায়। ওখান থেকে শিখে শব্দ সচেতনতা ও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে বাড়িতেই ওকে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলাম। এ ভাবেই ছেলে পড়াশোনা শিখছে। ছবি আঁকা শিখছে।” সাগরিকাদেবীর কথায়, “আমাদের মতো অনেক পরিবারেই এমন সন্তান রয়েছে। বাবা-মায়েরা হয়তো জানেন না, কী ভাবে সন্তানদের ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনের পথে ফিরিয়ে আনা যায়। আমার মনে হয়, এমন পদ্ধতিতে এগিয়ে চললে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা অসম্ভব নয়। বরং সন্তানের কথা ভেবে ভেঙে পড়লেই সমস্যা।”
৩ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে শিবমদের মতো ‘হার না মানা’ ছেলেমেয়েদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন রাজ্যপাল। পাণ্ডব পরিবারও সেই দিনটার জন্যই প্রহর গুনছে।
আর মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের মতোই লক্ষ্যে অটল থেকে জয়ের পথে এগিয়ে চলেছে পাণ্ডব পরিবারের এই খুদে সদস্য। |
|
|
|
|
|