মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। সেই মর্মে সমবায় আইনে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত বিধি সংশোধন করতে উদ্যোগীও হয়েছে রাজ্য সরকার। এই পথে চললে সমবায় ব্যবস্থাটাই যে ভেঙে পড়বে এবং ঋণ অনাদায়ী থেকে গেলে ভবিষ্যতে গরিব মানুষের আর সমবায়ের ঋণই জুটবে না, এই বার্তা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগেই আসরে নামতে চলেছে বামেরা।
বামফ্রন্টের রাজ্য স্তরে আলোচনা করে সমবায় বাঁচানোর আহ্বান সামনে রেখে গড়ে উঠতে চলেছে নতুন সংগঠন। তবে পরিস্থিতি বুঝে এই নতুন মঞ্চকে শুধু বামেদের জন্য সীমাবদ্ধ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে না। বস্তুত, উদ্যোগ বামেদের হলেও সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরই সামনে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। সমবায় ভেঙে পড়া মানে গ্রামে কৃষকদের চাষের সময় প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্যের পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে যাওয়া এই যুক্তি দেখিয়ে দল-মত নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষকে কাছে টানতে প্রয়াসী হয়েছেন বাম নেতৃত্ব।
তমলুকের একটি সমবায় ব্যাঙ্ক কয়েক মাস আগে ঋণখেলাপিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য নোটিস দিতেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কৃষক স্বার্থে আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসা মমতার সাফ ঘোষণা ছিল, ঋণ শুধতে না-পারলেই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। তাঁর সেই ইচ্ছা মেনেই রাজ্য সমবায় আইনে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং নিলামে ওঠা অর্থ শোধ করার জন্য ঋণখেলাপিকে দেওয়া সময়সীমার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করতে খসড়া তৈরি হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমবায়-কর্তাদের কাছে চিঠি আসছে: মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বলে দিয়েছেন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে না, তা হলে সমবায় ব্যাঙ্ক ঋণ আদায় করতে চেয়ে চাপ দিচ্ছে কেন?
সরকারকে লেখা চিঠির প্রতিলিপি দেখিয়ে ঋণগ্রস্তেরা সমবায়কে পাল্টা চাপ দিচ্ছেন, এমন উদাহরণও মিলছে! গোটা বিষয়ে রাজ্য সরকারের মনোভাবের ফলে সমবায় ব্যবস্থাই রসাতলে যেতে বসেছে বলে মনে করছেন বাম নেতৃত্ব। কেউ ঋণ নিয়ে দিনের পর দিন শোধ না করার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে মজা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা যে সমবায় ব্যাঙ্কেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার সামিল, এই সহজ যুক্তি দেখিয়ে কৃষকদের বিপদ বোঝানোর চেষ্টায় নামছেন তাঁরা।
এই প্রেক্ষাপটেই আগামী ডিসেম্বরে আত্মপ্রকাশ ঘটতে চলেছে নতুন সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ সমবায় বাঁচাও মঞ্চে’র। কলকাতায় ৯ ডিসেম্বর কনভেনশন করে তাদের কাজ শুরু হবে। বাম নেতৃত্বের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনায় ঠিক হয়েছে, সমবায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যুক্ত ব্যক্তিরাই এই মঞ্চের সামনের সারিতে থাকবেন। চার বাম দল সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের কাছে পাঁচ জন করে প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছে। তাঁরা যে সকলে প্রত্যক্ষ রাজনীতির পরিচিত মুখ হবে, তার কোনও মানে নেই। যত দিন না সংগঠন চালানোর জন্য নতুন কমিটি গড়ে না উঠছে, তত দিন বিষয়টি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিপিএম এবং ফ ব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য অমিয় পাত্র ও হাফিজ আলম সৈরানিকে।
বামেদের হিসাবে, রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের সমবায়ের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩৭ লক্ষ। রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্ক, কনফেড, বেনফেড, আবাসন ফেডারেশনের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিত্বদের দায়িত্ব দিয়ে নতুন মঞ্চের মাধ্যমে যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছতে চাইছেন বাম নেতৃত্ব। অমিয়বাবুর কথায়, “একটা নতুন উদ্যোগ শুরু হচ্ছে। সেখানে বাম-অবাম সবাই স্বাগত। তৃণমূল নিজেরা সমবায় চালাতে পারবে না, আমাদেরও চালাতে দেবে না। রাজ্য সরকারের মনোভাবে সমবায় ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে!” সস্তায় হাততালি কুড়োনোর জন্য সমবায়ের ঋণ পরিশোধে শিথিলতা দেখানোর যে পথ মুখ্যমন্ত্রী নিয়েছেন, তাতে অদূর ভবিষ্যতে কৃষকদেরই বিপদে পড়তে হবে বাম নেতৃত্ব মনে করছেন। অমিয়বাবুর যুক্তি, “এই ভাবে চললে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেউ আর্থিক সাহায্য দেবে না। সমবায় তার অর্থ আদায় করতে না-পারলে তারাও মানুষকে আর ঋণ দিতে পারবে না। গ্রামের মানুষ মহাজনের কাছে যেতে ভরসা পাবেন না চড়া সুদের জন্য। তার মানে তৃণমূলের নেতৃত্বে এই ভাবে মানুষকে চিট ফান্ডের খপ্পরে ফেলতে চাওয়া হচ্ছে! পথে নামা ছাড়া উপায় নেই।” ফ ব নেতা সৈরানির কথায়, “সমবায় ব্যাপারটাই যৌথ। নতুন সংগঠনেও যৌথ ভাবে সকলকে নিয়ে আন্দোলন হবে।”
বিভিন্ন জেলায় ইদানীং কালে নানা সমবায়ের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে জয় আসছে বামেদের। নতুন মঞ্চ গড়ে সমবায়ের পথে গ্রামে গ্রামে তাই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়েও নামতে চাইছে বিরোধী শিবির। |