|
|
|
|
এসেছে জয়, তবু মেজাজ হারাল ধোনি-বাহিনী |
গৌতম ভট্টাচার্য • আমদাবাদ |
ব্যাট-বলের তীব্র যুদ্ধের বাইরেও দুটো টিমের একে অপরের প্রতি কেমন গরগরে রাগের বারুদ জমা ছিল, সেটা বোঝা গেল টেস্টের শেষ দিন এসে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যিনি ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হিসেবে জগদ্বিখ্যাত, যাঁকে বলা হল বিয়র্ন বর্গের ক্রিকেট সংস্করণ কারণ, সব সময় ভাবলেশহীন থাকতে জানেন, তিনি কিনা ড্র হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকা টেস্ট জিতে কোথায় খুশিতে ডগমগ থাকবেন, তা নয়, আম্পায়ার এবং ইংরেজ টিম সম্পর্কে ক্রুদ্ধ মন্তব্য করলেন। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অধিনায়কত্ব-জীবনের সবচেয়ে বিরল ঘটনা। বিতর্কের কালো মেঘে কোথাও যেন চাপা পড়ল জয়ের নীল আকাশ।
সাড়ে চার দিনে ন’উইকেটে জিতে যাওয়া টেস্টের পর পুরস্কার বিতরণে এসে ধোনি ফট করে বলে দিলেন, “আমাদের বোলারদের খেটে দশ উইকেটেরও বেশি ফেলতে হয়েছে।” এমন কথা আইসিসি-র সরকারি মঞ্চে দাঁড়িয়ে সৌরভের মতো প্রতিবাদী নেতাও কোনও দিন বলেননি।
প্রাইজ দেওয়া শেষ হতে না হতেই রবি শাস্ত্রী টেনে নিয়ে গেলেন ভারত অধিনায়ককে। বললেন, “কী হয়েছে বলো তো?” ধোনির ক্ষোভ তখনও কমছে না, “এটা কোনও আম্পায়ারিং হয়েছে! মোট চোদ্দোটা ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে গোটা ম্যাচে। আমরা পেতাম নয়, ওরা পেত পাঁচ।” ধোনির অভিযোগ যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে টেস্ট শেষ দিনে গড়ানোরই কথা নয়। অ্যালিস্টার কুকের ইনিংসও মহাকাব্যিক স্তরে পৌঁছয় না। তিনি নাকি ৩২ রানে দিবালোকের মতো পরিষ্কার এলবিডব্লিউ ছিলেন প্রজ্ঞান ওঝার বলে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আসলে সিরিজে ১-০ এগিয়ে গিয়েও একটা রাগী, উত্তেজিত মননে বসবাসকারী মানুষ। তাঁর রাগ প্রকাশ্য হয় না, হয় না। আজ যখন হয়েছেব্যতিক্রমী সেই ক্ষোভ ত্রিমুখী। |
হচ্ছেটা কী
 |
সোয়ানের বুটে পিচে আঁচড়। আম্পায়ারদের দেখাচ্ছেন প্রজ্ঞান ওঝা। সোমবার মোতেরায়। ছবি: উৎপল সরকার |
আম্পায়ারিং উইকেট বিপক্ষ দল মোতেরা পিচ যদিও সোমবার প্রথম সাঁইত্রিশ মিনিটের মধ্যেই খেলার মোড় ভারতের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। ওঝার বলটা একটু থেমে এসেছিল। ম্যাট প্রায়র চামচ করে ক্যাচ দেওয়ার মতো তুলে দেন। কিছু পরেই কুকের মহাকাব্যিক ইনিংস শেষ ট্র্যাজিক পরিণতির মধ্যে। সাড়ে ন’ঘণ্টা যে লোকটা এমন অসামান্য বিচারবুদ্ধি দেখিয়ে ব্যাট করেছে, সে একটা সহজ বলের লেংথ বুঝতে ভুল করে কিনা বোল্ড। এত সব প্রতিকূলতার সঙ্গে এমনিতেই লড়তে হচ্ছিল। এর পর বল-বিচার ক্ষমতাও গিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করল। কী বললেন নিজেকে কুকব্রুটাস তুমিও! সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন, নিজের সম্পর্কে ঘেন্নায় যা উচ্চারণ করেছিলেন তার পর, সেটা আর লেখার যোগ্য নয়। বোঝা গেল চার অক্ষরের কোনও বিন্যাস হবে।
বল যে সামান্য হলেও ঘুরল। ইংল্যান্ড অল আউট হয়ে গেল লাঞ্চের আগেই, তাতে ভারত অধিনায়ক অভিভূত হওয়ার কিছু পাননি। মোতেরাটিম ইন্ডিয়ার সবচেয়ে অপয়া মাঠের একটাতে সাত বছর বাদে আসা প্রথম জয়েও না। বাংলা কথাধোনি পরের টেস্টগুলোয় চান টার্নার। প্রথম দিন থেকেই যে সারফেসের ওপর বল পড়ে ঘুরবে। এক ঘর ব্রিটিশ মিডিয়ার সামনে যে ভাবে বললেন, “বিদেশে গিয়ে যখন দেখি প্রথম দিন থেকে বল এতটা করে সিম করছে (বুঝতে হবে গত বছরের ইংল্যান্ড), কই তখন তো কেউ আওয়াজ তোলে না? সিম করায় যদি সমস্যা না থাকে, তা হলে বল ঘোরাতেই বা সমস্যা থাকবে কেন?” শুনে মনে হল ধোনির হঠাৎ হলটা কী!
মাঠের গণ্ডগোল নিয়েও প্রশ্ন উঠল। এই সিরিজটা যে দু’পক্ষের কাছেই অ্যাসেজের মতো মরণপণ লড়াই আর গত সিরিজে ভারতের ০-৪ হারা তলায় তলায় কী সাংঘাতিক ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার রেশ টের পাওয়া গেল কুক-বিদায়ের পরে। তখন বোঝাই যাচ্ছে ইংল্যান্ড টেস্ট হারছে। বড়জোর একশো রানের লিড পাবে। আর সেটা দিয়ে ভারতের এই ব্যাটিং লাইন-আপ থামানো সম্ভব নয়। আর আমদাবাদেরটা দু’দেশের মধ্যে ক্রিকেট-সম্পর্কের আশি বছর পূর্তির প্রথম টেস্ট। আশি বছরের প্রথম টেস্টে যদি এই কাণ্ড হত, তবু একটা মানে বোঝা যেত। তখন ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন ছিলেন ডগলাস জার্ডিন। ক্রিকেটের ক্রুর, হিংস্র স্ট্র্যাটেজির প্রথম উদ্ভাবক। তিনি যদি গ্রেম সোয়ানকে কাজটা করতে বলতেন, তা-ও বোঝা যেত। তা বলে অ্যালিস্টার কুক! না কি কুক নন, সদ্য তিনি ট্র্যাজিক হিরোর মতো আউট হয়ে ফিরছেন। তাঁর মাথা কাজ করার কথা নয় তখন। নিশ্চয়ই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মস্তিষ্ক হবে। সোয়ান পপিং ক্রিজের দু’পা বাইরে স্টান্স নিলেন। এই অবধি ঠিক আছে। ব্যাটসম্যান তো ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে দাঁড়াতেই পারে। কিন্তু তিনি বুটের স্টাড দিয়ে আঁচড় কাটা শুরু করলেন। এটা অবশ্যই অখেলোয়াড়োচিত। যার লক্ষ্য হল গুড লেংথ স্পটগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া। যাতে চতুর্থ ইনিংসে ভারত যত কম রানই তাড়া করুক, তারা যেন সমস্যায় পড়ে। ব্রেসনান তো উল্টো দিকে সতর্কিতই হলেন উইকেটের মধ্যে দৌড়তে গিয়ে। সেই এক অভিসন্ধিভারত ব্যাট করতে নামার আগে পিচ যেন যথাসম্ভব এবড়োখেবড়ো থাকে। এর আগে দৃষ্টিহীনও দেখতে পাবে এমন কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে স্টুয়ার্ট ব্রড দাঁড়িয়ে ছিলেন। টিমের মধ্যে আচার-ব্যবহারে সবচেয়ে নিরামিশাষী প্রজ্ঞান ওঝা আঙুল দিয়ে দেখালেন, যাও প্যাভিলিয়নে যাও। এখানে আর কী চাই বাবা? স্টুয়ার্ট ব্রড উত্তরে কিছু মিষ্টি করে বললেন। পরিবেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে গেল। এর আগে ভারতও চরম অসৌজন্য দেখিয়েছে কুকের আউট হওয়ার পর তাঁকে ন্যূনতম হাততালিটুকু না দিয়ে।
সাতাশ বছর বয়স কুকের। এই বয়সের মধ্যে তাঁর একুশটা সেঞ্চুরি। ভাবাই যায় না। একমাত্র তেন্ডুলকরের সাতাশ বছর বয়সে পঁচিশটা সেঞ্চুরি ছিল। আজ হয়তো টেস্ট বাঁচিয়ে ‘আথারটন’ হতে পারেননি। কিন্তু এ রকম একটা ইনিংস বিপক্ষ খেললেও হাততালি দেওয়াটা সৌজন্য। বিশেষ করে সে যখন আউট হয়ে চলেই যাচ্ছে। ধোনির ভারত আসলে সেই গরগরে রাগটা বোধহয় পুষছিল যে, স্কোরবোর্ড যতই তোকে ১৭৬ রান করেছিস বলে দেখাক, আমরা তো জানি তোকে কোন ক্রমিক সংখ্যা দিয়ে দেখা উচিত! ৩২। পাতি ৩২!
সামান্য রান তাড়া করে ভারত তো কতই জিতেছে দেশে-বিদেশে। কখনও তাদের এত উত্তেজিত ভাবে পাট চুকিয়ে দিতে দেখিনি। অথচ হাতে প্রচুর সময় ছিল। বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু সহবাগ আর গম্ভীরের অনুপস্থিতিতে পূজারা এমন মারলেন যেন আর দেরি করলে মুম্বই যাওয়ার বিকেল চারটের জেট ফ্লাইটটা মিস হয়ে যাবে। পূজারা আবার দারুণ ব্যাট করলেন। এ বার অপরাজিত ৪১। প্রথম ইনিংসের চেয়ে তফাত হল, এ বার রান করার ভঙ্গিতে ফুটে বার হচ্ছে ঔদ্ধত্য। আর একটা বার্তা, ধুর তোরা ফিফ্থ ডে অবধি এসেছিস এটাই তো ঢের। তিনি আর ওঝাএঁরা মুম্বইয়ের জাভেরিবাজারে ঘুরে বেড়ালে বা বান্দ্রা লিঙ্কিং রোড থেকে আগামী ক’দিনে মাল কিনলে কেউ চিনতে পারবে বলে মনে হয় না। দলে সবচেয়ে কম বিজ্ঞাপিত দু’জন। অথচ এক জন ব্যাটিং বিক্রমে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। অন্য জন ৯-১৬৫ দিয়ে বিপক্ষকে ভাঙলেন।
ও দিকে ইংল্যান্ড শিবিরে জোর ঝামেলা লেগে গিয়েছে। স্কাই টিভিতে এ দিন ইয়ান বোথাম বলেছেন, ইংল্যান্ড ড্রেসিংরুমে একটু বন্ধু-বন্ধু, সখী-সখী পরিবেশ চলছে বলে আমার মনে হচ্ছে। অবিলম্বে স্টুয়ার্ট ব্রডকে বসাও। মন্টি পানেসরকে মুম্বই টেস্টে খেলাও। আরও তিনটে বদল করো। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থেকো না। ব্রড পালটা টুইট করেছেন, ‘আমাদের প্রাক্তনদের বকবকানি শোনার আগে এক বার ওদের জিজ্ঞেস করে নিন, ভাইরা আপনারা গত আঠাশ বছর এ দেশে সিরিজ জিততে পারেননি কেন?’ পিটারসেনের বিপক্ষকে এসএমএস যদি শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়, ব্রডের টুইটটাও।
ভারতের এক সিনিয়র ক্রিকেটার যা শুনে খুব খুশি। বললেন, “যত ইচ্ছে হোক। নারদ নারদ।”
|
ভারত ৫২১-৮ ডিঃ
ইংল্যান্ড ১৯১ ও ৩৪০-৫
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৩৪০-৫) |
কুক বো প্রজ্ঞান ১৭৬
প্রায়র ক ও বো প্রজ্ঞান ৯১
ব্রেসনান ক পরিবর্ত (রাহানে) বো জাহির ২০
ব্রড ক ও বো উমেশ ৩
সোয়ান বো অশ্বিন ১৭
অ্যান্ডারসন নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ২১
মোট ৪০৬
পতন: ১২৩, ১৫৬, ১৬০, ১৯৯, ১৯৯, ৩৫৬, ৩৬৫, ৩৭৮, ৪০৬
বোলিং: উমেশ ২৩-২-৭০-৩, প্রজ্ঞান ৫৫-১৬-১২০-৪,
অশ্বিন ৪৩-৯-১১১-১, সহবাগ ১-০-১-০, জাহির ২৭.৩-৫-৫৯-২,
সচিন ১-০-৮-০, যুবরাজ ৪-০-১৭-০।
|
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস |
সহবাগ ক পিটারসেন বো সোয়ান ২৫
পূজারা নঃআঃ ৪১
কোহলি নঃআঃ ১৪
অতিরিক্ত ০
মোট ৮০-১
পতন: ৫৭
বোলিং: অ্যান্ডারসন ২-০-১০-০, সোয়ান ৭.৩-১-৪৬-১,
সমিত ৬-০-২৪-০। |
|
|
|
|
 |
|
|