শেষ বার তাঁহাকে ভারতের মাটিতে দেখা গিয়াছিল ১৯৮৭ সালে। তখনও তিনি মুক্ত রাজনীতিক। তাহার তিন বৎসরের মধ্যেই বন্দি ও গৃহান্তরিন হন বিশ্বের অন্যতম ‘আইকন’, মায়ানমারের বিরোধী নেত্রী অং সান সু চি। পঁচিশ বছর পর আবার তাঁহাকে দেখিতে পাইল ভারত। এক অর্থে তাঁহার এই পুনরাগমন তীর্থে প্রত্যাগমন। ঘটনাচক্রে ভারতের প্রগতি ও গণতন্ত্রের ভাবাদর্শেই আনখশির দীক্ষিত ও স্নাত এই নেত্রী। ভারতের পক্ষেও সু চি-র এই সফর এক ‘ফিরিয়া পাইবার’ মুহূর্ত: বর্তমান দুনিয়ায় যদি কাহাকেও মহাত্মা গাঁধীর যোগ্য উত্তরাধিকারী বলিয়া চিহ্নিত করিতে হয়, তাহা হইলে নেলসন ম্যান্ডেলার নামের প্রবল প্রতিযোগী হইবে অং সান সু চি-রই নাম। মায়ানমারের সামরিক শাসনের প্রেক্ষিতে, অতীব কঠিন পরিস্থিতিতে, প্রত্যক্ষ প্রাণভয়ের সঙ্গে নিয়ত যুঝিতে যুঝিতে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও নীতির লক্ষ্যাভিমুখে সংগ্রাম করিয়াছেন তিনি, তবু কখনও কোনও মুহূর্তে হিংসা, উত্তেজনা কিংবা আতিশয্যের লক্ষণ দেখান নাই। এই বরেণ্য নেত্রীর নিকট হইতে ভারতের অনেক কিছু জানিবার ও শিখিবার ছিল এই সফরকালে। কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি শুনা গেল, তাহা ভারতের নিজেরই পরিবর্তিত কূটনৈতিক দিশা বিষয়ে সমালোচনা। সু চি-র এই বারের সফরে বার বার সেই সমালোচনা শোনা গিয়াছে: কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও প্রকট।
কী সেই সমালোচনা? সু চি-র মতে, ভারতের যে দীপ্ত আদর্শের ঐতিহ্যে তিনি নিজে এবং বিশ্বময় বহু মানুষ দীক্ষিত, কূটনীতিতে ক্রমে সেই গণতান্ত্রিকতার নীতি হইতে সরিয়া আসিয়াছে ভারত। মায়ানমারের যে সামরিক জুণ্টা সরকার প্রাত্যহিক মানবাধিকার-দলনে সিদ্ধহস্ত, পশ্চিম দুনিয়া তাহাকে ব্রাত্য করিলেও ভারত কিন্তু বাস্তববাদিতার নামে সেই অগণতন্ত্রী, অনৈতিক, অমানবিক শাসনযন্ত্রের সহিত হাতে হাত মিলাইয়া সম্পর্ক গড়িতে পিছু হটে নাই। জওহরলাল নেহরুর প্রজ্বলিত আদর্শবাদিতার স্থানে বাস্তববাদিতাকে নিজের কূটনীতিতে প্রোথিত করিতে গিয়া যে যুক্তি দর্শানো হইয়াছে, তাহা সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থপরতারই নামান্তর। সু চি-র কাছে ইহা দুর্ভাগ্যজনক স্খলন, নিজেরই মহৎ অঙ্গীকারের পথ হইতে সুবিধাবাদী পশ্চাদপসরণ: নেহরুর ভারতের এই স্বার্থপরতা তাঁহাকে আহত করে। বাস্তবিকই, উনিশশো ষাটের দশকের পর হইতে ভারতের যে বাস্তববাদী কূটনীতির যাত্রারম্ভ, মায়ানমারের ক্ষেত্রেই তাহা সর্বাপেক্ষা প্রকট। কোনও না কোনও দিন মায়ানমারের বিরোধী শিবির, বিরোধী নেত্রীর নিকট হইতে এই ভর্ৎসনা ভারতের প্রাপ্যই ছিল। কোনও না কোনও দিন এই প্রশ্নের উত্তর দিল্লিকে দিতেই হইত।
সু চি-র এ বারের সফর অবশ্য প্রশ্নেরই লগ্ন, উত্তরের লগ্ন নহে। কিন্তু তাহা বলিয়া দিল্লির তরফে যে উত্তরটি অনুচ্চারিত রহিল, তাহা অপাংক্তেয় হইয়া যায় না। কূটনীতিতে আদর্শ বনাম বাস্তববাদ এক অতি জটিল ও পরিচিত দ্বন্দ্ব। সকল দেশকেই এই বিষয়ে অবস্থান লইতে হয়। যে দেশ আবার আঞ্চলিক মহাশক্তি, তাহাকে তো বিশেষ সাবধানেই অবস্থান লইতে হয়। নিজের নৈতিকতার আদর্শে অবিচল থাকিয়া অন্য দেশের সার্বভৌমতা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মানবশত সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। এই সহনশীলতার সংস্কৃতিও কিন্তু একটি মূল্যবান কষ্টার্জিত সম্পদ, গণতান্ত্রিক ভারতের কূটনীতির বাস্তববাদিতার সঙ্গে এই সহনশীলতা অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ঠিক যেমন, সু চি-র নিজের রাজনৈতিক দর্শনেও বিরোধিতার তীব্রতার সহিত প্রয়োজনে সহনশীলতার নীতিও গ্রহণীয়। সম্ভবত সেই কারণেই আপাতত যথেষ্ট মুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মায়ানমার সরকারের নির্মম রোহিঙ্গা-মুসলিম দমন-নীতির বিরুদ্ধে তিনি ততখানি সরব নন। ক্ষেত্রবিশেষে ধৈর্য, ক্ষেত্রবিশেষে তাড়িত সংগ্রাম, এই পথের মূল্য সু চি-র মতো নেত্রী জানেন। ভারতের মতো দেশও জানে। সংকীর্ণ সূত্রের উপর দিয়া এই বিপন্ন হণ্টনের দ্বন্দ্ব বড়ই গভীর। সু চি-র প্রশ্ন যেমন সঙ্গত, প্রশ্নের বিপরীতে দ্বন্দ্বটিও তেমন অবধারিত। ভারতের কূটনীতি সেই অবধারিত, দুরতিক্রম্য দ্বন্দ্বশিকলে বন্দি। তাহাকে প্রশ্ন করা যায়, উড়াইয়া দেওয়া যায় না। |