|
|
|
|
গুরুদাসকে ফোন তৃণমূল নেত্রীর |
কংগ্রেস স্বস্তিতে, মমতার মন জয়ই লক্ষ্য বিজেপির |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনাস্থা প্রস্তাব আসুক বা প্রকাশ কারাটের ১৮৪ ধারায় আলোচনা। মনমোহন সিংহ সরকারের সামনে আপাতত বিপদ নেই।
কংগ্রেসের নিজস্ব ২০৪ জন সাংসদ ধরে লোকসভায় ইউপিএ-র শক্তি ২৫২। কংগ্রেস সূত্রের খবর, তার সঙ্গে মায়াবতী-মুলায়ম ও দেবগৌড়ার জেডি (এস)-সহ আরও ৫০ জন সাংসদের সমর্থন তারা নিশ্চিত করে ফেলেছে। ইউপিএ-র বাইরে থাকা এই দলগুলির কেউই এখন সরকার ফেলে দিতে চায় না।
এই রকম পরিস্থিতিতেই আলোচনায় উঠে আসছে লোকসভায় বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজকে ফোন করে মমতার সমর্থন প্রার্থনা। বিজেপি-র সংসদীয় দলের বৈঠক বসছে কাল। কিন্তু সেখানেও মূল প্রশ্ন এখন আর সরকারের পতন নয়। বরং, অনেক বেশি করে যে প্রশ্ন উঠে আসছে, সেটা হল মমতার অনাস্থা ধোপে টিকবে কি না? বস্তুত, রাজধানীর রাজনীতির চর্চায় এখন চলে এসেছে ‘ওয়ান আপম্যানশিপে’র খেলা! অর্থাৎ কাকে টেক্কা দিয়ে কে এগোবে? কারাটের ১৮৪ না মমতার অনাস্থা?
কংগ্রেস শিবিরে প্রাথমিক ভাবে আস্থা প্রস্তাব আনার ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন তারা অনেক আত্মবিশ্বাসী। দলের মুখপাত্র রশিদ অলভির যুক্তি, খামোখা আগেভাগে আস্থা প্রস্তাব আনতে যাব কেন? বিরোধীরাই তো ছত্রভঙ্গ! তারা যা করার করুক! |
|
মমতার প্রস্তাব মাথায় রেখেই এর পরে আলোচনায় বসছে বিজেপি। দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী বলছেন, “আমরা অনাস্থা আনছি না। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাব না। তার চেয়ে মমতার মতো কেউ প্রস্তাব আনলে আমাদের সমর্থন করতে অসুবিধা কোথায়?”
কিন্তু, মমতার ঘোষিত অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হতে গেলে লোকসভার ৫০ জন সাংসদের সমর্থন লাগবে। সেই সংখ্যা জোগাড় হবে কী করে, তার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর এখনও নেই। মমতা তাঁর মতো করে নানা সম্ভাবনা পরখ করে দেখছেন। যেমন, আজই তিনি সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তকে ফোন করেছিলেন। গুরুদাসবাবু রবিবার কলকাতায় বলেছিলেন, তৃণমূল বা যে দলই অনাস্থা আনুক, সরকারকে বাঁচানোর দায় তাঁদের নেই। এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই সিপিআই সাংসদকে ফোন করে মমতা বলেছেন, তাঁর আনা প্রস্তাব নিয়ে সমস্যা থাকলে বামেরা বরং নিজেরাই অনাস্থা আনুক। তিনি সেই প্রস্তাব সমর্থন করবেন। এ ব্যাপারে সিপিএম-কে বোঝানোর জন্য গুরুদাসবাবুকে অনুরোধ করেছেন মমতা। তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা গুরুদাসবাবুকে বলেছেন, কংগ্রেস সবাইকে বিজেপি-র ‘জুজু’ দেখাচ্ছে! কিন্তু নিজেরা দু’বেলা তাদের সঙ্গে কথা বলছে! গুরুদাসবাবু অবশ্য মমতাকে বলেছেন, তাঁর এই বক্তব্য তিনি দলীয় মঞ্চে জানাবেন।
রাজনীতির কারবারিদের অনেকের মতে, সরকারের যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেটা এখন মোটের উপর স্পষ্ট। ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতোই ফের একঘরে মমতা। সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতেই এক দিকে তিনি যেমন বিজেপি-র দিকে হাত বাড়াচ্ছেন, তেমনই আবার গুরুদাসবাবুকে পাল্টা প্রস্তাব দিচ্ছেন।
মমতা যে বিজেপি-র নেত্রী সুষমাকে ফোন করেছিলেন, গত কাল কলকাতায় সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন মুরলীমনোহর জোশী। এ প্রসঙ্গে মমতার বক্তব্য, “সুষমা স্বরাজের সঙ্গে এক বার কেন, একশো বার আলোচনা হতে পারে! বিজেপি-র সঙ্গেও আমরা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু এখনও এই আলোচনা শুরু করিনি।” তাঁর প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী যদি বিজেপি নেতাদের নৈশভোজে ডাকতে পারেন, আডবাণী এবং সুষমার সঙ্গে যদি সিপিএম
নেতারা আলোচনা করে রণকৌশল ঠিক করতে পারেন, তা হলে তৃণমূল সংসদের রণকৌশল নিয়ে বিজেপি-র সঙ্গে আলোচনা করলে গেল গেল রব তোলার অর্থ কী?
আডবাণীও বলছেন, “কিছু দিন আগে গুরুদাসবাবু ও বাসুদেব আচারিয়া সংসদে সুষমার সঙ্গে বৈঠক করতে এসেছিলেন। বাম নেতাদের অনুরোধে আমি সেই বৈঠকে হাজির হয়েছিলাম। গুরুদাসবাবু সেই বৈঠকে বলেছিলেন, আমরা নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করছি। কিন্তু তাঁরা তখন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। সুতরাং এই রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতার যে প্রশ্ন অ-বিজেপি ও অ-কংগ্রেসি দলগুলো তুলছে, তা আজকের দিনে অপ্রাসঙ্গিক!”
মমতারও যুক্তি, “কিছু দিন আগেই রাজ্যসভায় লোকপাল বিল নিয়ে বিতর্কে বিজেপি-সিপিএম একসঙ্গে ভোট দিয়েছিল। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সমস্ত বিলে বিজেপি ও বাম একসঙ্গে ভোট দিয়েছে। পরমাণু চুক্তিতেও ওরা একসঙ্গে ভোট দিয়েছিল। ১৯৬২ সালে নেহরুর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবেও সিপিআই ও জনসঙ্ঘ একসঙ্গে ভোট দিয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু চলছে!” কারাট অবশ্য বলছেন, “সংসদে বাম ও বিজেপি অনেক সময়ই একই প্রশ্নে বিরোধিতা করে। কিন্তু বিজেপি-র সঙ্গে আমাদের কোনও রাজনৈতিক সমঝোতায় যাওয়া সম্ভব নয়।” মমতার পাল্টা বক্তব্য, “আমরাও বিজেপির সঙ্গে কোনও জোট করছি না। আমরা ইউপিএ ও এনডিএ থেকে সমদূরত্ব নিয়ে চলছি। বিজেপি-র সঙ্গে জোট তৈরির কথা যে বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবাস্তব!”
তবে মমতার পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও সরকার ফেলা যে কঠিন সেটা বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন। আর সরকার এক বার জিতে গেলে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বিরোধিতাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে মমতাকে সমর্থন না-করলেও মুশকিল।
বস্তুত, ভবিষ্যতে মমতাকে এনডিএ-তে নিয়ে আসার জন্য ইতিবাচক বার্তা পাঠাতেই তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করতে চাইছেন আডবাণী-সুষমারা। কিন্তু বিজেপি-র মধ্যে এই নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আডবাণী অবশ্য দলকে বলেছেন, তাঁরা যদি অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন না-করেন, তা হলে সরকারই আস্থা প্রস্তাব নিয়ে আসবে। সরকার কিছুতেই বামেদের ১৮৪ ধারায় আনা প্রস্তাবে ভোটাভুটি করতে চাইবে না। সরকার চাইবে, ১৯৩ ধারায় আলোচনা হোক, যাতে ভোটাভুটি না হয়। এ হেন পরিস্থিতিতে সরকারের আনা আস্থা প্রস্তাবে বিরোধিতা করার থেকে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়াটা বিজেপি-র পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে শ্রেয়। আগামী কাল দলীয় বৈঠকে আডবাণী দলের শীর্ষ নেতাদের এই যুক্তি দেখিয়ে মমতার অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করার পক্ষে রায় দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
সরকার পতনের সম্ভাবনা ক্রমশ বিলীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মমতার কৌশল হল, অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গেলেও দুর্নীতির প্রশ্নে কমিউনিস্ট ও অন্যান্য দলগুলি সরকারকে বাঁচাচ্ছে বলে তিনি প্রচার করবেন। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে প্রশ্ন থাকছেই যে, মমতা কি ধীরে ধীরে বিজেপি-র দিকে ঝুঁকছেন? কংগ্রেস যত আক্রমণাত্মক হচ্ছে, বাম দলগুলির সঙ্গেও একটা বোঝাপড়ার দিকে চলেছে, তখন মমতা কি বিজেপি-র দিকে ধীর লয়ে এগোচ্ছেন? না কি তৃণমূল এই আক্রমণাত্মক রণকৌশলের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গেও একটা রফা করার চেষ্টা করবে? মমতা কি কংগ্রেস এবং বিজেপি দু’দিকের দরজাই খোলা রাখতে চাইছেন?
প্রশ্ন অনেক। সব উত্তর এখনই সুলভ নয়! |
|
|
|
|
|