তেলে জলে মিশ খেলেও খেতে পারে! কিন্তু ব্যবসা আর রাজনীতি কখনও মেশে না। রাজ্যের শিল্পায়নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ দেখে এমন মন্তব্যই করছেন শিল্পপতি এবং বিরোধী রাজনীতিকেরা। তাঁদের মতে, রাজনীতিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখে শিল্প টানার চেষ্টা করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
অতএব ঢাকঢোল পিটিয়ে ডিসেম্বরে শিল্প সম্মেলন যতই হোক, দিল্লি এখনও দূর অস্ত!
সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ন্যানো কারখানা তাড়িয়ে, শিল্পের জন্য জমি নেওয়া আটকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা। ফলে তাঁর সরকারকে ঘিরে শিল্পমহলের আতঙ্ক এবং সংশয় স্বাভাবিক। তাই গত দেড় বছরে তেমন কোনও দরের শিল্পপতি এ রাজ্যে পা ফেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। সে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যতই লক্ষ কোটি টাকা লগ্নি টানার দাবি করুন না কেন!
বিরোধী দলনেত্রী থাকার সময় যে আন্দোলন করা যায়, ক্ষমতা দখলের পরে তা-ই যে বুমেরাং হয়ে আসে, সেটা বিলক্ষণ বুঝছেন মমতা। কিছু করে দেখানোর চাপ এখন তাঁর উপর। কেন শিল্প আসছে না, কেন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, রাজ্যের শিক্ষিত যুব সমাজের ভবিষ্যৎ কী এই সব প্রশ্ন প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে। সেই নেতিবাচক ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলতে এখন উদ্যোগী হয়েছেন মমতা। বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি শিল্প-বিরোধী নন। লগ্নি টানা নয়, দিল্লিতে যে শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করছে রাজ্য সরকার, এই রাজনৈতিক বার্তা দেওয়াই তার মূল লক্ষ্য বলে শিল্পমহলের একটা বড় অংশের মত।
রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখে কী করতে পারতেন মুখ্যমন্ত্রী।
শিল্পপতিরা বলছেন, কোনও রাজ্যে লগ্নি করার অর্থ তার সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদি একটা সম্পর্ক তৈরি করা। আস্থা সেই সম্পর্কের অন্যতম প্রাক্ শর্ত। পশ্চিমবঙ্গ, বিশেষ করে তার মুখ্যমন্ত্রীর উপর সেই আস্থাটাই আর নেই।
এই অনাস্থা যে গত দেড় বছরে তৈরি হয়েছে এমনটা কিন্তু নয়। রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই নিজের সংস্কার-বিরোধী ভর্তুকি-নির্ভর ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন মমতা। তার পর যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর কারণে যে ভাবে বিদায় করেছেন দীনেশ ত্রিবেদীকে, বা যে ভাবে বাস ভাড়া এক বার বাড়িয়ে আবার কমিয়েছেন, তাতে আরও পোক্ত হয়েছে সেই ভাবমূর্তি। যাতে ইন্ধন জুগিয়েছে, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে তাঁর বিরোধিতা। সেখানেও রাজনীতিকেই অর্থনীতির আগে রেখেছেন তৃণমূল নেত্রী।
অথচ এ দু’টিকে যে আলাদা করা যায় না তা নয়। কেন্দ্রে রাজনীতির তাগিদে এফডিআই-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিজেপি। অথচ গুজরাত বা মধ্যপ্রদেশে তাদের মুখ্যমন্ত্রীরা কিন্তু মমতার মতো আদাজল খেয়ে ময়দানে নামেননি।
জমি নিয়ে মমতার অবস্থানও সমান জটিল। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে লেখা আছে, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। সেই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার কথা গত দেড় বছরে অসংখ্য বার বলেছেন মমতা। পশ্চিমবঙ্গের যা বাস্তব পরিস্থিতি, তাতে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া শিল্পপতিদের পক্ষে সরাসরি জমি কেনা অত্যন্ত কঠিন, এটা জানার পরেও। এনটিপিসি-কে সরাসরি জমি কিনে নিতে বলার পরে কার্যত বিশ বাঁও জলে চলে গিয়েছে কাটোয়ার তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
তবু জমি কফিনের শেষ পেরেক নয়, বলছে শিল্পমহল। গত বছর শিল্পপতিদের সঙ্গে বিজয়া সম্মেলনে তাঁদের বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মতো পিছিয়ে পড়া জেলায় যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, সেখানে জমি পাওয়া তুলনামূলক ভাবে সোজা। যেতে আপত্তি ছিল না শিল্পপতিদের। তাঁরা চেয়েছিলেন, সরকার সড়ক-জল-বিদ্যুতের মতো পরিকাঠামো দিক। কিন্তু তাতেও আপত্তি মমতার। তিনি চান, সবই গড়ে নিন শিল্পপতিরা।
এখানেই শেষ নয়! শালবনিতে ইস্পাত কারখানা গড়তে এসে মমতার রাজত্বে জমি নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে জিন্দলদের। তাঁরা নিজেরাই জমি কিনেছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বসীমা আইনের গেরোয় সেই জমি তাঁরা রাখতে পারেন না। ফলে নিজেদের কেনা জমি সরকারকে দিয়ে, আবার টাকা গুনে সরকারের কাছ থেকে লিজ নিতে হয়েছে তাঁদের। “এই যদি অবস্থা হয়, তা হলে শিল্পপতিরা আসবেন কেন,” ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যেরই এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী।
শিল্পমহলের বক্তব্য, নিজেরা জমি কিনলেও আইনি প্রক্রিয়া পেরিয়ে কত তাড়াতাড়ি সেই জমি হাতে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট নীতিই সরকারের নেই। সেই নীতি না থাকলে জমিতে টাকা ঢালার পরে আদৌ তা ব্যবহার করা যাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের ক্ষেত্রে
প্রতিটি লগ্নি প্রস্তাব আলাদা আলাদা ভাবে (কেস টু কেস) বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছে রাজ্য। যা থেকে স্বজনপোষণের জন্ম হয় বলেই অনেক শিল্পপতির অভিযোগ। তাঁদের বক্তব্য, সরকারের এই অবস্থানই বুঝিয়ে দেয় যে, প্রশাসনিক রীতি নয়, রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দই তাদের চালিকা শক্তি। এমন পরিস্থিতিতে আর যা-ই হোক, লগ্নি সুগম হয় না।
বস্তুত, রাজনীতির অঙ্কই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজারহাটে অর্থতালুক গড়ার পথে। বাম আমলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে শুরু হয়েছিল এই অর্থ তালুক গড়ার কাজ। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি বেসরকারি সংস্থাকে। মমতা এসেই তাদের কাছ থেকে দায়িত্ব কেড়ে নেন। ঘোষণা করেন, হিডকো নিজেরাই এই অর্থতালুক গড়বে। এক অর্থতালুকের দ্বিতীয় বার উদ্বোধন হয় মমতার হাতে। অনেকেই মনে করেন, প্রণববাবু আর বাম সরকারের ছোঁয়া থাকার কারণেই তৃণমূল নেত্রীর এমন সিদ্ধান্ত।
কিন্তু তাদের গড়া অর্থতালুক কেমন হবে, সে ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট দিশা দেখাতে রাজ্য সরকার ব্যর্থ বলেই শিল্পমহলের মত। অর্থতালুকের পরিকাঠামো আর্থিক সংস্থাগুলিকে ভাড়া দেওয়ার বাইরে অন্য কোনও উদ্যোগ তারা দেখছে না। শিল্পমহলের মতে, এই তালুককে সার্বিক অর্থে আর্থিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র করে তুলতে গেলে সেখানে ঋণপত্র এবং বিদেশি মুদ্রা লেনদেনের ব্যবসা টেনে আনা জরুরি। কিন্তু এই পথে হাঁটার কোনও লক্ষণ রাজ্য সরকার এখনও দেখায়নি।
রাজনীতিই যে তৃণমূল সরকারকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে, তার উদাহরণ হিসেবে হলদিয়া থেকে এবিজি-র বিদায়কে তুলে ধরছে শিল্পমহল। ন্যানো কাণ্ডের সঙ্গে এই ঘটনার তুলনা করে বহু শিল্পপতিরই প্রশ্ন, রাজনীতির ধাক্কায় যদি এ ভাবে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়, তা হলে রাজ্যে লগ্নি করার সাহস আসবে কোথা থেকে। তাঁদের অভিযোগ, অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে শিল্পকে রক্ষা করা হবে, এমন কোনও ইঙ্গিত সরকারি নীতিতে নেই।
আর ঠিক সেই কারণেই রাজ্যে এক দিকে যেমন নতুন শিল্প আসছে না, তেমনই থমকে যাচ্ছে প্রস্তাবিত প্রকল্পও। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, কাজ শুরু হয়ে আটকে যাওয়া প্রকল্পের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এ বছরে তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে।
শিল্পমহলের এই ভীতি কাটাতে যা করা দরকার ছিল, গত দেড় বছরে তার কিছুই করেনি তৃণমূল সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে যতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, শিল্পপতিদের সঙ্গে ততটা নয়। গত এক বছরে বলতে গেলে কোনও শিল্পপতির সঙ্গে দেখা করেননি মুখ্যমন্ত্রী। (তাঁর বিজয়া সম্মেলনকে কোনও গুরুত্বই দিতে নারাজ শিল্পমহল। কারণ, সেখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না।) শিল্পমহলের অনুষ্ঠানেও তাঁকে প্রায় দেখাই যায় না। এখানেও রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গ বজায় রেখেছেন মমতা। টাটাদের হোটেল বলে তাজ বেঙ্গলে একটি অনুষ্ঠানে যাননি তিনি। ও পথ মাড়াননি রাজ্যের কোনও মন্ত্রীও।
আবার সেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই শিল্প-বিরোধী নন এমন ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ময়দানে নেমেছেন মমতা। হলদিয়ায় আয়োজন করা হচ্ছে ‘বেঙ্গল লিডস’, দিল্লিতে শিল্প সম্মেলন। যা দেখে রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের বক্তব্য, “শিল্পপতিদের নিয়ে সম্মেলন করাটা আবশ্যিক। কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। আসল কথা হল শিল্পের জন্য পরিবেশ তৈরি করা। লগ্নিকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই কাজ করতে পারলে আমরা খুশি হব।
কিন্তু গত দেড় বছরে তারা সেটা করে উঠতে পারেনি।”
সাধারণ ভাবে এই মতের শরিক হলেও প্রকাশ্যে অবশ্য এত কড়া কথা বলছে না শিল্পমহল। স্বাভাবিক কারণেই। ফিকির পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা গৌরব স্বরূপ যেমন দিল্লিতে শিল্প সম্মেলন করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “লগ্নি টানতে অন্য রাজ্যেও যেতে হবে। এটা প্রতিযোগিতার বাজার। লগ্নি চাইলে রাজ্য সরকারকে অন্য রাজ্যে গিয়ে লগ্নিকারীদের বার্তা দিতে হবে।” একান্তে কিন্তু এই বার্তা দেওয়াকে অন্ধের এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন শিল্পমহলের অনেকে। |